জ্ঞান, আগুন আর ষড়যন্ত্র: নালন্দা পুড়ল কেন তিন মাস ধরে?

জ্ঞান, আগুন আর ষড়যন্ত্র: নালন্দা পুড়ল কেন তিন মাস ধরে?

ভাবুন তো, এক বিশাল পাঠাগার, যেখানে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বই থরে থরে সাজানো। জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার। আর সেই সব বইকে গিলে খাচ্ছে উন্মত্ত আগুনের লেলিহান শিখা। তিন মাস ধরে জ্বলছে সেই আগুন! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! এমনই এক ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল প্রাচ্যের জ্ঞানতীর্থ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়-এর। আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বের মেধাবী শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল ছিল, তাকে ছারখার করে দিয়েছিল এক তুর্কি যোদ্ধা। কিন্তু কেন? কিসের এত রাগ, কিসের এত বিদ্বেষ?

নালন্দা: যেখানে জ্ঞান ছিল অনন্ত!

‘নালন্দা’ শব্দটার অর্থই হলো জ্ঞানের অনন্ত প্রবাহ। এর চেয়ে সার্থক নাম আর কী হতে পারে! যদি টাইম মেশিন থাকত, তাহলে একবার ঘুরে আসা যেত সেই স্বর্ণযুগে। মনে মনে ইতিহাসের পাতায় ডুব দিলেই ভেসে ওঠে এক গমগমে মহাবিহারের ছবি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী গমগম করছে চারিদিক। কাড়া-নাকাড়ার শব্দে মুখরিত প্রবেশদ্বার, আর সেখান দিয়ে প্রবেশ করছেন স্বয়ং হিউয়েন সাং! তাঁর আর ইৎসিংয়ের মতো চৈনিক পরিব্রাজকদের লেখায় লুকিয়ে আছে সেই হারানো সময়ের অসংখ্য অমূল্য তথ্য।

কল্পনা করুন, দশ হাজার ছাত্র আর প্রায় দুই হাজার শিক্ষক! চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা – পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভিড় জমাতেন এখানে। তবে নালন্দার দ্বার সবার জন্য খোলা ছিল না। প্রবেশ করতে দিতে হত কঠোর পরীক্ষা। মূল তোরণে উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং শিক্ষকরা, কঠিন সব প্রশ্নে যাচাই করে নিতেন প্রার্থীর মেধা। বেশিরভাগই প্রত্যাখ্যাত হতেন! যারা সুযোগ পেতেন, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই ছিল না। আর শিক্ষকদের কথা কী বলব! আর্যভট-এর মতো গণিতজ্ঞ ছিলেন এখানকার অধ্যক্ষ! বসুবন্ধু, ধর্মপাল, নাগার্জুন, পদ্মসম্ভব, হিউয়েন সাং – এমন সব কিংবদন্তী নাম জড়িয়ে আছে এই মহাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

৪২৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা কুমারগুপ্তের আমলে বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা গড়ে তুলেছিলেন এই অসাধারণ শিক্ষাকেন্দ্র। বৌদ্ধধর্মের গবেষণা ছিল মূল, তবে পাশাপাশি পড়ানো হত হিন্দুদর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞানের আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজকীয় অনুদানে চলত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব খরচ।

নালন্দা: যেখানে জ্ঞান ছিল অনন্ত

আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখানে মেধা ছিল একমাত্র প্রবেশাধিকার! রাজপরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও কোনো পক্ষপাতিত্বের সুযোগ ছিল না। শিক্ষার্থীরা শুধু বিনামূল্যে পড়াশোনা করত না, তাদের জন্য ২০০টি গ্রাম থেকে আসত দুধ, ঘি, চাল, মাখন – সব পুষ্টিকর খাদ্য!

‘ধর্মগঞ্জ’: যেখানে লুকানো ছিল জ্ঞানের রত্ন!

নালন্দার সবচেয়ে বড় গর্ব ছিল এখানকার পাঠাগার। এর নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’। ভাবতেই পারছেন না, কত বিশাল ছিল এটি! তিনটি অতিকায় বহুতল বিশিষ্ট ভবন ছিল – ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নোদধি’ এবং ‘রত্নরঞ্জক’। ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত, এখানে লক্ষাধিক বই ছিল। উপনিষদের কয়েকটি অংশের আসল পাণ্ডুলিপি, প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, গুহ্যসমাজের মতো ধর্মগ্রন্থ – এমন আরও কত অমূল্য সম্পদ! আর সেই সব অমূল্য রত্ন শেষ পর্যন্ত গিলে খেয়েছিল উন্মত্ত আগুন। এবার শুনুন সেই ভয়াবহ ঘটনার পেছনের কারণ।

বিদ্বেষের আগুন: এক চিকিৎসকের প্রতিশোধ?

নালন্দার উপর আক্রমণ এর আগেও হয়েছে। হুন সম্রাট মিহিরকুল আর বাংলার গৌরদাস রাজবংশের হামলায় ক্ষতি হয়েছিল, কিন্তু নালন্দা বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে যখন তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজির বাহিনী বিহারের এই অঞ্চলে আছড়ে পড়ল, তখন ৮০০ বছরের এই প্রতিষ্ঠান পরিণত হলো জ্ঞান ও মেধার এক অনন্ত শ্মশানে।

কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ?

উত্তর ভারতে হামলা চালানোর সময় খিলজি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কোনো চিকিৎসাতেই তার অবস্থা ভালো হচ্ছিল না। তখন কেউ তাকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদের প্রধান রাহুল শ্রীভদ্রের কাছে যেতে বললেন। কিন্তু অহংকারী খিলজি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না যে, ভারতের কোনো চিকিৎসক তুরস্কের চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি যোগ্য!

শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে খিলজি রাহুলের দ্বারস্থ হলেন, কিন্তু একটা অদ্ভুত শর্ত জুড়ে দিলেন – তিনি কোনো ওষুধ খাবেন না! রাহুল কিন্তু দমে গেলেন না। তিনি খিলজিকে কোরানের কয়েকটি পাতা পড়তে দিলেন। আর এতেই ঘটে গেল ম্যাজিক! আশ্চর্যজনকভাবে খিলজি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন!

আসলে রাহুল কোরানের ওই নির্দিষ্ট পাতায় ওষুধ লাগিয়ে রেখেছিলেন। খিলজি পড়তে পড়তে অজান্তেই সেই ওষুধ সেবন করে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই ঘটনায় খিলজি খুশি হওয়ার বদলে উল্টো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন! তিনি বুঝলেন, ভারতের চিকিৎসকরা তুরস্কের চিকিৎসকদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী ও সক্ষম! এই উপলব্ধিই তার মধ্যে জন্ম দিল এক ভয়ানক বিদ্বেষ।

 নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস

এক ধ্বংসযজ্ঞের করুণ কাহিনি!

এই বিদ্বেষের ফল হলো ভয়াবহ! খিলজি আদেশ দিলেন নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস করার। তারপর যা ঘটল, তা ভাবলে আজও সভ্যতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। শত শত বছরের সঞ্চিত জ্ঞান, চর্চা, মেধা – সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেল! হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো, কারো কারো মাথা কেটে ফেলা হলো। যারা প্রাণে বাঁচলেন, তারা পালিয়ে গেলেন। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেল জ্ঞানের এই মহান পীঠস্থান।

খিলজির রাগের পিছনে এই জনপ্রিয় গল্পটিই সত্য, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর কারণ ছিল, তা বলা কঠিন। তবে কারণ যাই হোক না কেন, এই উন্মত্ত ক্রোধের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা কেবল ভারতের নয়, সমগ্র এশিয়ার শিক্ষাজগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। আজও ইতিহাসপ্রেমী মানুষের সংবেদনশীল মন চোখের সামনে দেখতে পায়, কীভাবে এক মহান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীর ঘৃণা আর বিদ্বেষের আগুনে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল!

RIma Sinha

Rima Sinha is a professional journalist and writer with a strong academic background in media and communication. She holds a Bachelor of Arts from Tripura University and a Master’s degree in Journalism and Mass Communication from Chandigarh University. With experience in reporting, feature writing, and digital content creation, Rima focuses on delivering accurate and engaging news stories to Bengali readers. Her commitment to ethical journalism and storytelling makes her a trusted voice in the field.

Recent Posts