অনুপ্রেরণামূলক ছোটো গল্প, Inspirational short stories in Bengali :

অনুপ্রেরণামূলক ছোটো গল্প

আপনারা সকলেই হয়তো ছোটবেলায় বহু অনুপ্রেরণামূলক ছোটো গল্প পড়ে থাকবেন। ছেলেবেলার সেই গল্পগুলো থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পেয়েছিলাম, যেমন খরগোশ ও কাছিমের গল্প, সিংহ ও কুয়োর গল্প ইত্যাদি।

বর্তমান সময়ে ডিজিটাল যুগের শিশুদের গল্প পড়ার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ থাকে না। কিন্তু এসব গল্প পড়ার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে, একথা অস্বীকার করার হয়। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা কয়েকটি অনুপ্রেরণামূলক ছোটো গল্প তুলে ধরবো।

দুঃখী ময়ূর

অনেকের মনেই উচ্চাভিলাষ থাকে। তবে উচ্চাভিলাষ রাখা কোন খারাপ জিনিস না হলেও এটি সাধারণত লোভের দিকে অগ্রসর হওয়ার মাঝে খুব পাতলা রেখা হয়ে থাকে।

দুঃখী ময়ূর

সাধারণত বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের ভালো কিছু করার জন্য কঠোরভাবে চাপ দিতে পারেন, ফলে বাচ্চারা একসময় হতাশ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, কিছু বাচ্চারা অভিভাবকদের কাছে ইতিমধ্যে যা আছে তার কথা বিবেচনা না করেই আরও বেশি কিছু দাবি করতে শুরু করে দিতে পারে। আজ এমনই একটি বিষয় নিয়ে এক ময়ূরের গল্প বলবো।

একসময় জঙ্গলে একটি সুন্দর ময়ূর ছিল। সে একদিন বৃষ্টির দিনে আপন মনে নাচছিল। বৃষ্টিতে তাঁর পুচ্ছ ছড়িয়ে দিতেই তা এতটা সুন্দর লাগছিল যে সে নিজেই নিজের পুচ্ছ দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ছিল। কিন্তু সে যখন নিজের পুচ্ছের প্রশংসায় ব্যস্ত ছিল, তখন তার রুক্ষ স্বর তাকে তার মধ্যে থাকা ত্রুটিগুলির কথা মনে করিয়ে দিল।

এভাবে তার মনের সকল আনন্দ যেন বৃষ্টির জলে ধুইয়ে গেল। তারপর, সে কাঁদতে শুরু করল। হঠাৎ, সে খুব কাছেই একটি নাইটঅ্যাঙ্গেলের ডাক শুনতে পেল। নাইটঅ্যাঙ্গেলের মধুর কণ্ঠ শুনে সে যেন তার নিজের মধ্যেকার ত্রুটি আরও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারল। সে তখন ভাবতে শুরু করল যে, কেন সে এমন দুর্ভাগ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে?

সেই মুহুর্তে, তার সামনে ঈশ্বরদের দলপতি উপস্থিত হয়ে ময়ূরের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করলেন, “তোমার মন খারাপ কেন?”। ময়ূর তখন তার রুক্ষ স্বর সম্পর্কে অভিযোগ জানালো। সাথে আরো বললো, “নাইটঅ্যাঙ্গেলের এমন সুন্দর কণ্ঠস্বর রয়েছে। আমার কেন নেই?”

ময়ূরের কথা শুনে ঈশ্বরদের দলপতি ব্যাখ্যা করলেন, “প্রতিটি জীব তার নিজস্ব পদ্ধতিতে বিশেষ হয়। হ্যাঁ, নাইটঅ্যাঙ্গেলের একটি সুন্দর কন্ঠ অবশ্যই আশীর্বাদ, তবে তুমিও আশীর্বাদপ্রাপ্ত, এমন একটি সুন্দর এবং ঝলমলে পুচ্ছ দিয়ে! সুখী থাকার আসল কৌশলটি হল গ্রহণযোগ্যতা এবং তোমার কাছে যা রয়েছে তার মাধ্যমে ভাল কিছু অর্জন করা।”

এসব শুনে ময়ূর বুঝতে পারল যে সে এতোটাই বোকা যে নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে এবং নিজের পাওয়া সৌভাগ্যকে বুঝতে পারেনি এবং অবহেলা করতে শুরু করেছিল। সে সেদিন বুঝতে পারল, প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে অনন্য।

গল্পের শিক্ষা : এই গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে,  স্ব–গ্রহণযোগ্যতাই হল সুখের প্রথম পদক্ষেপ। আপনি যা পারেন না বা আপনার যা নেই তা নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়ার চেয়ে আপনার যা আছে তার সেরাটিকে নিয়ে নিজেকে তৈরি করুন।

বুদ্ধিবল

 এক যে ছিল কুকুর, আর ছিল এক মোরগ। দুইজনের ছিল গলায় গলায় বন্ধুত্ব। একবার দুই বন্ধু একসঙ্গে দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিল। কিন্তু পথে যেতে যেতে রাত্রি হয়ে গেল। রাত হতেই মোরগটা এক গাছের ওপরে একটা ভাল ডাল বেছে নিয়ে সেখানে ঘুমোতে গেল।

কুকুর আর মোরগ

এদিকে কুকুরটা রইল ঐ গাছেরই গোড়ায় এক বড়সড় গর্তে। নিজের নিজের স্থানে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে আসছে। ভোর হতেই মোরগ তার অভ্যাস মত ডেকে উঠল। তার সেই ডাক শুনে এক খেঁকশিয়ালীর বড় লোভ হল।

একটু দূরেই সে তার ছানাপোনা নিয়ে বাস করতো, সেখান থেকে মোরগের ডাক শুনতে পেয়েছিল সে। মোরগের লাভ সে এগিয়ে এল সেই গাছের তলায়। তারপর সেই খেঁকশিয়ালী মোরগকে ধরার জন্য গাছের ডালের দিকে চেয়ে মোরগকে মিষ্টি করে বলল, সত্যিই কি সুন্দর গলা তোমার, শুনে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, নেমে এসো, আমি তোমায় আলিঙ্গন করবো।

এই কথা শুনে মোরগটিও উত্তরে মিষ্টি করে বলল যে, দেখো এই গাছের নিচে আমার দারোয়ান ঘুমোচ্ছে, তাকে আগে জাগাও, সে উঠে দরজা খুলে দিক, তখন আমি নিচে নামতে পারব। একথা শুনে খেঁকশিয়ালী তখন খুঁজছিল, কোথায় সেই দারোয়ান! কাকে দরোজা খোলার কথা বলতে হবে! তখন কুকুরটি উঠে এক লাফে খেঁকশিয়ালীর ঘাড় চেপে ধরল। তারপর তাকে কামড়ে মেরে ফেলল।

গল্পের শিক্ষা :  এই গল্প থেকে আমরা এই উপদেশ  পাই যে, দুর্বলেরা সবলের সাহায্য নিয়ে অতি সহজেই শত্রু দমন করতে পারে ।

পূর্ণ চেষ্টা সাফল্য আনে

এক গ্রামে রাজু ও সাজু নামে দুই বন্ধু থাকতো। দুই বন্ধুর মধ্যে দুবছরের তফাৎ ছিল। রাজুর বয়স ছিল ৫ বছর এবং সাজুর বয়স ৭ বছর। একদিন দুই বন্ধু গ্রাম থেকে কিছু দূরে খেলতে যায়। একটি পুরোনো কূপের পাশে তারা খেলছিল।

পূর্ণ চেষ্টা সাফল্য আনে

কিন্তু খেলতে গিয়ে তাদের সাথে এক বিপত্তি ঘটে যায়। সাজু খেলতে খেলতে হঠাৎ কূপে পরে যায়৷ এদিকে বন্ধুর এই অবস্থায় পাচ বছর বয়সী রাজু তাকে কূপ থেকে জল ওঠানোর জন্য বালতি এবং রশি ব্যাবহার করে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিল।

কিন্তু কূপে পরে যাওয়া সাজু ওজনে রাজুর চেয়ে বেশি ছিল। ওরা গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে এসে খেলছিল বলে তাদের আসেপাশে সাহায্য করার জন্যও কেউ ছিল না।

তাই বয়সে ছোট রাজু জলে পড়ে যাওয়া সাজুর কান্না দেখে একাই নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রশিটি টানতে শুরু করলো। সে বহু চেষ্টা করে তার মনের এবং দেহের পূর্ণ ইচ্ছা শক্তি রশিতে কেন্দ্রীভূত করে ফেলে৷ এই মুহূর্তে তার মনের মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা ছিল যে এই রশি টেনে তার বন্ধুকে তুলতে হবে, না হলে তার বন্ধু মারা যাবে।

অসীম চেষ্টার পর ছেলেটি ঠিকই বন্ধুকে উপরে তুলে আনতে সক্ষম হল। তারপর দেরি না করে দুজনে গ্রামে ফিরে এলো। গ্রামে এসে সবাইকে এ ঘটনা বলতে লাগলো। কিন্তু সবাই তাদের কথা অবিশ্বাস করলো৷ অনেকে ভাবলো যে তারা দুষ্টুমি করে মিথ্যে বলছে। সকলেই তাদের বলল যে, “সে তোমার ওজনে প্রায় দ্বিগুণ তুমি তাকে কিভাবে টেনে তুলবে?”

তবে গ্রামের একজন বৃদ্ধ তাদের কথায় বিশ্বাস করলো। বৃদ্ধ যখন সবাইকে বলেছে যে ঘটনা সত্য, তখন সবাই অবাক হয়ে গেল, সকলে ভাবতে লাগলো যে কি কারনে তিনি এটা বললেন। তখন বৃদ্ধ সবাইকে বললো যে, “মানুষের বিপদে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় এবং অন্য কোথাও থেকে সাহায্যের আশা থাকেনা তখন মানুষ তার সাধ্যের বাইরে গিয়েও চেষ্টা করতে পারে।”

গল্পের শিক্ষা : বিপদ সম্মুখে থাকলে কেউ যদি সাহায্যের জন্য না থাকে, তখন মানুষ নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করেও সফলতা পেতে পারে।

যে যেমন করে তার কাছেই তা ফিরে আসে

 একজন কৃষক প্রতিদিন একটি রুটির দোকানে গিয়ে এক কেজি করে পনির বিক্রি করতো এবং এর বদলে এক কেজি করে রুটি কিনে নিয়ে আসত। রুটির দোকানদারের সাথে কৃষকের অনেক পুরোনো পরিচয় হওয়ায় দোকানদার তার থেকে পনির নেয়ার সময় আর মাপ দেয়ার প্রয়োজন মনে করতো না।

যেমন কর্ম তেমন ফল

একইভাবে কৃষকও দোকান থেকে এক কেজি রুটি কোন মাপঝোপ ছাড়াই নিয়ে যেতো। একদিন পনিরের দোকানে এক নতুন কর্মচারী কাজ করতে এলো, সেদিন কৃষক যখন পনির বিক্রি করতে আসলো তখন কর্মচারী পনির ওজন করে দেখলো।

ওজন করতে গিয়ে দেখা গেলো যে কৃষকের নিয়ে আসা পনিরের পরিমাণ এক কেজির চেয়ে ১০০ গ্রাম কম আছে। তারপর কর্মচারী দোকান মালিককে ঘটনা জানালো। এই ঘটনা শুনে দোকানদার খুব রেগে গেলো এবং কৃষককে খুব বকাঝকা করলো। সে বাজারে বিচার ডেকে কৃষকের ব্যাপারে নালিশ করলো যে কৃষক তাকে ঠকিয়ে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম করে কম পনির দিয়েছে।

বিচারক যখন কৃষকের কাছে চুরির কারণ জানতে চাইলো, তখন কৃষক বললো – “আমি খুব গরীব মানুষ হুজুর , কিন্তু চোর নই। আমার বাসায় পরিমাপ করার কোন পাল্লা নেই, তাই প্রতিদিন রুটির দোকান থেকে যে ১ কেজি রুটি নিয়ে যাই সেটি দিয়েই ওজন করে দোকানদারকে সমপরিমান পনির দিয়ে যাই। তাই আমার জানা ছিলনা যে এখানে ১০০ গ্রাম রুটি কম ছিল।”

 এরপর এই ব্যাপারে রুটির পরিমাপ অনুসন্ধান করে কৃষকের কথা সত্য প্রমাণিত হলো এবং দোকানদার সবার সামনে লজ্জিত হলো ।

গল্পের শিক্ষা : যেমন কর্ম তেমন ফল ।

              ———————————-

অনুপ্রেরণামূলক গল্প পড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ টিপস, Special Tips for Reading Inspirational Stories :

  • অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন গল্পগুলি পড়ার সর্বোত্তম সময় হল দিনের বেলা। এর কারণ দিনের বেলা মস্তিষ্ক সতর্ক থাকবে এবং সহজে ক্লান্ত বোধ হবে না। কিন্তু কখনো রাতে বিছানায় যাওয়ার সময় অথবা শুয়ে শুয়ে এইসব গল্প পড়লে সঠিকভাবে মনোযোগ আকর্ষণ হয় না।
  • একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প সবসময় গুরুতর কোনো বিষয় নিতে হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। হাসিঠাট্টার গল্পের মধ্য দিয়েও অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষা পাওয়া যায়।
  • কোনো অভিভাবক যদি নিজের শিশুদের অনুপ্রেরণামূলক ছোটো গল্প শিয়ে থাকেন, তবে গল্পের শেষে আপনার সন্তানের কাছে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন, যে তারা এর থেকে কি শিক্ষা পেলো। এতে আপনি বুঝতে পারবেন যে সে গল্পের নীতিকথা বুঝতে পেরেছে কি না।
  • আপনি শিশুদের কাছে গল্প বলতে গিয়ে যদি মনে করেন যে আপনার সন্তান মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে, তবে গল্প বলা থামান এবং তারপরে কি ঘটতে পারে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে বলুন, এতে তাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পাবে।

শেষ কথা, Conclusion :

অনুপ্রেরণামূলক ছোটো গল্প পড়তে ছোটো থেকে বড় সকল বয়সের মানুষই আনন্দ পান। এই গল্পগুলো থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে যায়, বিশেষ করে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয় এই ধরনের গল্পগুলো। আশা করি উপরে উল্লেখিত গল্পগুলো আপনাদের ভালো লেগেছে। এই গল্পগুলো অবশ্যই আপনার সন্তানদের সাথে ভাগ করে নেবেন।

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts