কবি নজরুল ইসলামের লেখা প্রেমের কবিতা, Love poems written by poet Nazrul Islam in Bengali

কবি নজরুল ইসলামের কথা উল্লেখ মাত্রই আমাদের মনে তাঁর লেখা প্রতিবাদী কবিতার কথা এসে পরে। খুব কম মানুষই হয়তো তাঁর প্রেমিক মনোভাবের পরিচয় পেয়েছেন। প্রেম ও বিদ্রোহ বৈপরিত্যপূর্ণ হলেও, কবির লেখনীর কাছে তা হার মেনেছে। তাই তিনি এই দুটো বিষয়কেই সমান্তরালে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা খ্যাতিমান কবি নজরুল ইসলামের রচিত প্রেমের কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর কবিতা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

আমার কোন কুলে আজ
– কাজী নজরুল ইসলাম

আমার কোন কুলে আজ ভিড়লো তরী
এ কোন সোনার গাঁয়?
আমার ভাটির তরী আবার কেন
উজান যেতে চায়?
দুখেরে কান্ডারী করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙ্গা তরী
তুমি ডাক দিলে কি স্বপন পরী
নয়ন ইশারায় গো?
নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিলে ঝড়ের রাতি
কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়?
সোনার দেশের সোনার মেয়ে
ওগো হবে কি মোর তরীর নেয়ে
এবার ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে
রাঙা অলকায়।।
আমার কোন কুলে আজ

আমি যার নূপুরের ছন্দ
– কাজী নজরুল ইসলাম

আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর
কে সেই সুন্দর, কে?
আমি যার বিলাস যমুনা, বিরহ বিধুর
কে সেই সুন্দর, কে?
যাহার গলে আমি বনমালা
আমি যার কথার কুসুমডালা
না দেখা সুদূর
কে সেই সুন্দর, কে?
যার শিখীপাখা লেখনী হয়ে
গোপনে মোরে কবিতা লেখায়
সে রহে কোথায় হায়?
আমি যার বরষার আনন্দ কেকা
নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা
যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর
কে সেই সুন্দর, কে?

আপন – পিয়াসী
– কাজী নজরুল ইসলাম

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়,
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়।।
আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।
আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম,
অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
আপনারি গলে দোলে হায়।।
 
বেদনা-মণি

বেদনা-মণি
– কাজী নজরুল ইসলাম

একটি শুধু বেদনা মানিক আমার মনের মণিকোঠায় 
সেই তো আমার বিজন ঘরে দুঃখ রাতের আঁধার টুটায়।
সেই মানিকের রক্ত-আলো
ভুলাল মোর মন ভুলাল গো।
সেই মানিকের করুণ কিরণ আমার বুকে মুখে লুটায়।
আজ রিক্ত আমি কান্না হাসির দাবি দাওয়ার বাঁধন ছিঁড়ে
ওই বেদনা-মণির শিখার মায়াই রইল একা জীবন ঘিরে।
এ কালফণী অনেক খুঁজি
পেয়েছে ওই একটি পুঁজি গো!
আমার  চোখের জলে ওই মণিদীপ আগুন হাসির ফিনিক ফোটায়।

ব্যথা-নিশীথ
– কাজী নজরুল ইসলাম

এই নীরব নিশীথ রাতে
শুধু জল আসে আঁখিপাতে।
কেন  কি কথা স্মরণে রাজে?
   বুকে কার হতাদর বাজে?
   কোন্‌ ক্রন্দন হিয়া-মাঝে
   ওঠে গুমরি’ ব্যর্থতাতে
        আর  জল ভরে আঁখি-পাতে।।
মম বর্থ জীবন-বেদনা
   এই  নিশীথে লুকাতে নারি,
   তাই  গোপনে একাকী শয়নে
   শুধু নয়নে উথলে বারি।
   ছিল সেদিনো এমনি নিশা,
   বুকে জেগেছিল শত তৃষা
   তারি ব্যর্থ নিশাস মিশা
   ওই শিথিল শেফালিকাতে
   আর পূরবীতে বেদনাতে।।
 
চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে

চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে
– কাজী নজরুল ইসলাম

চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে
ছোটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।
হেরিছে রজনী রজনী জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।
না জানি সজনী কত সে রজনী
কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া
হেরেছে শশীরে সরসী মুকুরে
ভীরু ছায়া তরু কাঁপিয়া।
কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী
চিরবিরহিণী রোহিণী ভরণী
অবশ আকাশ বিবশা ধরণী
কাঁদানীয়া চাঁদিনীতে।।

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি
– কাজী নজরুল ইসলাম

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশিথ অন্ধকারে
দোয়া কর, মোরে দোয়া কর
আর আমারে লইয়া খেলোনা নিঠুর খেলা
শত কাঁদিলেঅ ফিরিবেনা
সেই শুভ লগনের বেলা
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতী
আমি কি কোনদিন এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।
মনের মানুষ

মনের মানুষ
– কাজী নজরুল ইসলাম

ফিরনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল?
    মুখের পানে চেয়ে এমন কেউ কি হেসেছিল?
          অনেক তো সে ছিল বাঁশি,
          অনেক হাসি, অনেক ফাঁসি,
কই  কেউ কি ডেকেছিল আমায়, কেউ কি যেচেছিল?
ওগো  এমন করে নয়ন-জলে কেউ কি ভেসেছিল?
     তোমরা যখন সবাই গেলে হেলায় ঠেলে পায়ে,
           আমার সকল সুধাটুকুন পিয়ে,
     সেই তো এসে বুকে করে তুলল আপন নায়ে
           আচমকা কোন্ না-চাওয়া পথ দিয়ে।
           আমার যত কলঙ্কে সে
     হেসে বরণ করলে এসে
আহা  বুক-জুড়ানো এমন ভালো কেউ কি বেসেছিল?
ওগো  জানত কে যে মনের মানুষ সবার শেষে ছিল।

নদীপারের মেয়ে
– কাজী নজরুল ইসলাম

নদীপারের মেয়ে!
ভাসাই আমার গানের কমল তোমার পানে চেয়ে।
আলতা-রাঙা পা দুখানি ছুপিয়ে নদী-জলে
ঘাটে বসে চেয়ে আছ আঁধার অস্তাচলে।
নিরুদ্দেশে ভাসিয়ে-দেওয়া আমার কমলখানি
ছোঁয় কি গিয়ে নিত্য সাঁঝে তোমার চরণ, রানি?
নদীপারের মেয়ে!
গানের গাঙে খুঁজি তোমায় সুরের তরি বেয়ে।
খোঁপায় গুঁজে কনক-চাঁপা, গলায় টগর-মালা,
হেনার গুছি হাতে বেড়াও নদীকূলে বালা।
শুনতে কি পাও আমার তরির তোমায়-চাওয়া গীতি?
ম্লান হয়ে কি যায় ও-চোখে চতুর্দশীর তিথি?
নদীপারের মেয়ে!
আমার ব্যথার মালঞ্চে ফুল ফোটে তোমায়-চেয়ে।
শীতল নীরে নেয়ে ভোরে ফুলের সাজি হাতে,
রাঙা উষার রাঙা সতিন দাঁড়ায় আঙিনাতে।
তোমার মদির শ্বাসে কি মোর গুলের সুবাস মেশে?
আমার বনের কুসুম তুলি পর কি আর কেশে?
নদীপারের মেয়ে!
আমার কমল অভিমানের কাঁটায় আছে ছেয়ে!
তোমার সখায় পূজ কি মোর গানের কমল তুলি?
তুলতে সে-ফুল মৃণাল-কাঁটায় বেঁধে কি অঙ্গুলি?
ফুলের বুকে দোলে কাঁটার অভিমানের মালা,
আমার কাঁটার ঘায়ে বোঝ আমার বুকের জ্বালা?
তোমায় যেমন করে ডেকেছিল

তোমায় যেমন করে ডেকেছিল
– কাজী নজরুল ইসলাম

তোমায় যেমন করে ডেকেছিল আরব মরুভূমি;
ওগো আমার নবী প্রিয় আল আরাবী,
তেমনি করে ডাকি যদি আসবে নাকি তুমি।।
যেমন কেঁদে দজলা ফোরাত নদী
ডেকেছিল নিরবধি,
হে মোর মরুচারী নবুয়তধারী,
তেমনি করে কাঁদি যদি আসবে নাকি তুমি।।
যেমন মদিনা আর হেরা পাহাড়
জেগেছিল আশায় তোমার
হে হযরত মম, হে মোর প্রিয়তম,
তেমনি করে জাগি যদি আসবে নাকি তুমি।।
মজলুমেরা কাবা ঘরে
কেঁদেছিল যেমন করে,
হে আমিনা- লালা, হে মোর কামলীওয়ালা,
তেমনি করে চাহি যদি আসবে নাকি তুমি।।

তরুণ প্রেমিক
– কাজী নজরুল ইসলাম

তরুণ প্রেমিক, প্রণয় বেদন
জানাও জানাও বে-দিল প্রিয়ায়
ওগো বিজয়ী, নিখিল হূদয়
কর কর জয় মোহন মায়ায়।
নহে ও এক হিয়ার সমান
হাজার কাবা হাজার মস্‌জিদ
কি হবে তোর কাবার খোঁজে
আশয় খোঁজ তোর হূদয় ছায়ায়।
প্রেমের আলোয় যে দিল্‌ রোশন
যেথায় থাকুক সমান তাহার
খুদার মস্‌জিদ মুরত মন্দির
ইশাই দেউল ইহুদখানায়।
অমর তার নাম প্রেমের খাতায়
জ্যোতির লেখায় রবে লেখা
দোজখের ভয় করে না সে
থাকে না সে বেহেস্তের আশায়।।
ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান

ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান
– কাজী নজরুল ইসলাম

ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান
আসিবে আজ বন্ধু মোর।
স্বপন মাখিয়া সোনার পাখায়
আকাশে উধাও চিত-চকোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।
নদীর পারে বন কিনারে
ইঙ্গিত হানে শ্যাম কিশোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
চন্দ্রচূড় মেঘের গায়
মরাল-মিথুন উড়িয়া যায়,
নেশা ধরে চোখে আলো-ছায়ায়
বহিছে পবন গন্ধ চোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
 

শেষ কথা, Conclusion :

কাজী নজরুল ইসলাম সর্বোচ্চ খ্যাতি লাভ করেছিলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে, কিন্তু এর বাইরেও তিনি প্রেম ও প্রকৃতিরও কবি। নজরুলের বেশ কিছু আবেগ ভরা প্রেমের কবিতার ডালি আপনাদের জন্য পরিবেশন করা হলো। কবিতাগুলো আপনাদের মনোগ্রাহী হলে অবশ্যই আপনার পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে এই প্রতিবেদনটি শেয়ার করবেন।

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts