জাতীয় শোক দিবস বাংলাদেশের এক অতি মর্মান্তিক ও তাৎপর্যপূর্ণ দিবস হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশে এই বিশেষ দিনটিতে ১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার স্মরণে পালিত একটি জাতীয় দিবস।
প্রতিবছরের তাই ১৫ আগস্ট জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিবসটি শোকের সাথে পালন করা হয়। এ দিবসে কালো পতাকা উত্তোলন ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় শোক দিবস, Bangabandhu and National Mourning Day
তিরিশ লক্ষ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত এ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির প্রতীক, হয়ে উঠেছিলেন সকল প্রেরণার উৎস। তবে মর্মান্তিক সেই দিনে ঘাতকেরা স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকারকে হত্যা করার মাধ্যমে বাঙালির যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল তার প্রতিদান বাঙালি হয়তো কোন দিন, কোন সময় দিতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা মহান স্বাধীনতার রূপকার।
১৯৪৮ সালে ভাষার দাবিতে গঠন করা হয়েছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বসহ ১৯৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ এর ৬-দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ’৭০ এর নির্বাচনসহ বাঙালির মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলন। এইসবেই নেতৃত্ব দেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর ফল স্বরূপ তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়।
নারকীয় হত্যাকান্ড, Infernal murder
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাসস্থানে সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে সপরিবার সমেত নিহত হন।
ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, হত্যাকারীদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।
সৌভাগ্যক্রমে, এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
মূলত, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশে সূত্রপাত ঘটে এক বিপরীত ধারার যাত্রার। বেসামরিক সরকারকে উৎপাটিত করে সামরিক শাসনের অনাচারী ইতিহাস রচিত হতে থাকে।
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর গোটা বিশ্বে ছেয়ে যায় তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেচিলেন , মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল এই বলে -‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার হয় খুনি মাজেদ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণ, The reason for killing Bangabandhu
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে বিবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমে যেটা বলা যেতে পারে সেটি হল যে প্রধানত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এজন্য দায়ী। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি তথা ষড়যন্ত্রকারীরা দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করতে চেয়েছিল।
নব্য স্বাধীন দেশটির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা ও ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। তারা এটিও চেয়েছিল যে চুড়ান্ত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত চিন্তা-চেতনাকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে দেশের চাকাকে পশ্চাদমুখী করতে। এর ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার, Trial of bangabandhu’s killers
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল ২১ বছর। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিচার কার্য শেষে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া পলাতক অবস্থায় খুনিদের একজন মারা গেছেন বলে জানা যায়। এখনও পলাতক রয়েছেন পাঁচ আসামি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার, Celebrating the National Day of Mourning
প্রতি বছর ১৫ আগস্ট জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল সদস্যদের স্মরণ করে জাতীয় শোক দিবস পালন করে। গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। নিহতদের কবরে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতিহা পাঠ ও সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদানসহ বিশেষ মুনাজাত ও দোয়া মাহফিল হয়।
এই দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বিশেষ মুনাজাত ও কোরআন তিলাওয়াত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সকালে ধানমন্ডিতে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শেখ মুজিবুর রেহমানের আদর্শ এবং অবদান, Ideology and achievements of Sheikh Mujibur Rahman
বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। ফাঁসির মঞ্চেও তিনি বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে । বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তাঁর নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন জাতির পিতার নাম এ দেশের লাখো-কোটি বাঙালির অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হবে জ্ঞানগরিমায় সমৃদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। তাহলেই আমরা চিরঞ্জীব এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন করতে পারবো।
শেষ কথা, Conclusion
বাঙালি জাতির শোক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় যাতে পালন করা হয় বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের তা খেয়াল রাখা উচিত। সকলকে একযোগে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ, ” স্বপ্নের সোনার বাংলা” প্রতিষ্ঠার মধ্য
দিয়ে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো এবং বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় উপনীত করতে পারলে জাতীয় শোক দিবস পালন সফল ও সার্থক হবে।
জাতীয় শোক দিবস সম্পর্কিত আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনটি যদি আপনাদের মনোগ্রাহী হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তার নিজের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে ও আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে শেয়ার করে নিতে ভুলবেন না।