প্রকৃতপক্ষে, অতীত এবং বর্তমানের সমস্ত সভ্যতার জন্ম হয়েছিল নদীর তীরে। একটি নদী প্রশস্ত এবং গভীর হতে পারে, অথবা একজন ব্যক্তির পক্ষে ওপারে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট অগভীর হতে পারে। নদী ভাঙা- গড়ার খেলার সঙ্গে মানুষ বরাবরই যুক্ত।
বাঙালির জীবনের সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততার কারণে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে এর শক্তিশালী উপস্থিতি সহজেই লক্ষণীয়। উপন্যাস, গল্প, সাহিত্য, স্মৃতিকথা, কবিতা ও ছড়া, গান ও চলচ্চিত্রে নদীর উল্লেখ তথা উপস্থিতি পাওয়া যায়। বাংলার সাহিত্য রচনা একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে।
নদীর কথা ভেবে বহু কবি লিখে গেছেন অনবদ্য কবিতাসমূহ। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে অনলাইনে নদী নিয়ে লেখা কবিতাসমূহ খোঁজ করে থাকেন, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন।
নদী নিয়ে লেখা জীবনানন্দ দাশের কবিতা, Jibanananda Das’s poem on river :
একদিন জলসিড়ি নদীর ধারে
একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে,
– জীবনানন্দ দাশ
বিশীর্ন বটের নীচে শুয়ে রব- পশমের মত লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে-
বাঁকা চাঁদ জেগে রবে- নদীটির জল,
বাঙ্গালি মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের
ধূসর কপাটে আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে-
তারপর যেই ভাঙ্গা ঘাটে
রূপসীরা আজ আর আসে নাকো,
পাট শুধু পচে অবিরল,
সেইখানে কলমির দামে বেধে প্রেতনীর মত কেবল
কাঁদিবে সে সারা রাত-
দেখিব কখন কারা এসে আমকাঠে
সাজায়ে রেখেছে চিতাঃ বাংলার শ্রাবনের বিস্মিত আকাশ চেয়ে রবে;
ভিজে পেচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি-শাদা শাখা-বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে
ভাঙ্গিতেছে ধীরে ধীরে-
চারিদিকে জীবনের এই সব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস।
নদী
বঁইচির ঝোপ শুধু — শাঁইবাবলার ঝাড়–আর জাম হিজলের বন–
– জীবনানন্দ দাশ
কোথাও অর্জুন গাছ–তাহার সমস্ত ছায়া এদের নিকটে টেনে নিয়ে
কোন কথা সারাদিন কহিতেছে অই নদী?–এ নদী কে?–ইহার জীবন
হৃদয়ে চমক আনে;যেখানে মানুষ নাই–নদী শুধু–সেইখানে গিয়ে
শব্দ শুনি তাই আমি– আমি শুনি– দুপুরের জলপিপি শুনেছে এমন
এই শব্দ কতদিন;আমিও শুনেছি ঢের বটের পাতার পথ দিয়ে
হেঁটে যেতে–ব্যাথা পেয়ে;দুপুরে জলের গন্ধে একবার স্তব্ধ হয় মন;
মনে হয় কোন শিশু মরে গেছে, আমার হৃদয় যেন ছিল শিশু সেই;
আলো আর আকাশের থেকে নদী যতখানি আশা করে–আমিও তেমন
একদিন করি নি কি? শুধু একদিন তবু? কারা এসে বলে গেল, ‘ নেই–
গাছ নেই– রোদ নেই,মেঘ নেই– তারা নেই–আকাশ তোমার তরে নয়! ‘–
হাজার বছর ধরে নদী তবু পায় কেন এই সব? শিশুর প্রাণেই
নদী কেন বেঁচে থাকে?–একদিন এই নদী শব্দ ক’রে হদয়ে বিস্ময়
আনিতে পারে না আর; মানুষের মন থে নদী হারায়– শেষ হয় ।
স্বভাব
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
– জীবনানন্দ দাশ
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ’লে,
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক’রে চলে।
সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে
মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো
তার সেই মূর্তি এসে পড়ে।
সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি
যেন তার নিজের জিনিস।
এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে
সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ
তাহ’লে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয়
দু–একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে
যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ
আচ্ছন্ন মাছির মতো মরে—
তবুও একটি নারী ‘ভোরের নদীর
জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে’
এ–রকম দু–চারটে ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা
ভেবে শেষ হ’য়ে গেছে একদিন সাধারণভাবে।
নদী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা, Rabindranath Tagore’s poem on river :
অজয় নদী
এককালে এই অজয়নদী ছিল যখন জেগে
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্রোতের প্রবল বেগে
পাহাড় থেকে আনত সদাই ঢালি
আপন জোরের গর্ব ক’রে চিকন-চিকন বালি।
অচল বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে যখন ক্রমে ক্রমে
জোর গেল তার কমে,
নদীর আপন আসন বালি নিল হরণ করে,
নদী গেল পিছনপানে সরে;
অনুচরের মতো
রইল তখন আপন বালির নিত্য-অনুগত।
কেবল যখন বর্ষা নামে ঘোলা জলের পাকে
বালির প্রতাপ ঢাকে।
পূর্বযুগের আক্ষেপে তার ক্ষোভের মাতন আসে,
বাঁধনহারা ঈর্ষা ছোটে সবার সর্বনাশে।
আকাশেতে গুরুগুরু মেঘের ওঠে ডাক,
বুকের মধ্যে ঘুরে ওঠে হাজার ঘূর্ণিপাক।
তারপরে আশ্বিনের দিনে শুভ্রতার উৎসবে
সুর আপনার পায় না খুঁজে শুভ্র আলোর স্তবে।
দূরের তীরে কাশের দোলা, শিউলি ফুটে দূরে,
শুষ্ক বুকে শরৎ নামে বালিতে রোদ্দুরে।
চাঁদের কিরণ পড়ে যেথায় একটু আছে জল
যেন বন্ধ্যা কোন্ বিধবার লুটানো অঞ্চল।
নিঃস্ব দিনের লজ্জা সদাই বহন করতে হয়,
আপনাকে হায় হারিয়ে-ফেলা অকীর্তি অজয়।
নদী
ওরে তোরা কি জানিস কেউ
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জলে কেন ওঠে এত ঢেউ।
ওরা দিবস – রজনী নাচে,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে।
শোন্ চলচল্ ছলছল্
সদাই গাহিয়া চলেছে জল।
ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে,
ওরা কার কোলে ব’সে দুলে।
সদা হেসে করে লুটোপুটি,
চলে কোনখানে ছুটোছুটি।
ওরা সকলের মন তুষি
আছে আপনার মনে খুশি।
আমি বসে বসে তাই ভাবি,
নদী কোথা হতে এল নাবি।
কোথায় পাহাড় সে কোত্থানে,
তাহার নাম কি কেহই জানে।
কেহ যেতে পারে তার কাছে,
সেথায় মানুষ কি কেউ আছে।
সেথা নাহি তরু নাহি ঘাস,
নাহি পশুপাখিদের বাস,
সেথা শব্দ কিছু না শুনি,
পাহাড় বসে আছে মহামুনি।
তাহার মাথার উপরে শুধু
সাদা বরফ করিছে ধুধু।
সেথা রাশি রাশি মেঘ যত
থাকে ঘরের ছেলের মতো।
শুধু হিমের মতন হাওয়া
সেথায় করে সদা আসা যাওয়া।
নদী নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা, Poem written by Kazi Nazrul Islam on river :
নদী এই মিনতি তোমার কাছে
নদী এই মিনতি তোমার কাছে।
– কাজী নজরুল ইসলাম
ভাসিয়া নিয়ে যাও আমারে যে দেশে মোর বন্ধু আছে॥
নদী তোমার জলের পথ ধরে সে চলে গেল একা,
আমি সেই হতে তার পথ চেয়ে রই, পেলাম না আর দেখা,
ধুলার এ পথ নয় যে বন্ধু থাকবে চরণ-রেখা।
আমি মীন হয়ে রহিব জলে, ছুটব ঢেউ-এর পাছে।
আমি ডুবে যদি মরি, তোমার নয় সে অপরাধ,
কূলে থেকে পাইনে খুঁজে, তাই জেগেছে সাধ
আমি দেখব ডুবে তোমার জলে আছে কি মোর চাঁদ,
বড়ো জ্বালা বুকে রে নদী টেনে লহো কাছে।
নদী, অভাগা এই যাচে॥
এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা
এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।
– কাজী নজরুল ইসলাম
সকাল বেলা আমির, রে ভাই (ও ভাই) ফকির, সন্ধ্যাবেলা॥
সেই নদীর ধারে কোন্ ভরসায়
বাঁধলি বাসা, ওরে বেভুল, বাঁধলি বাসা, কিসের আশায়?
যখন ধরলো ভাঙন পেলি নে তুই পারে যাবার ভেলা।
এই তো বিধির খেলা রে ভাই এই তো বিধির খেলা॥
এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি, মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ, তার খোঁজ নিল না কেহ (রে ভাই)।
রাতে রাজা সাজে নাচমহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে বটের তলে
শেষে শ্মশান ঘাটে গিয়ে দেখে সবাই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই ভব নদীর খেলা॥
নদীর স্রোতে মালার কুসুম
নদীর স্রোতে মালার কুসুম
– কাজী নজরুল ইসলাম
ভাসিয়ে দিলাম প্রিয়
আমায় তুমি নিলে না,
মোর ফুলের পূজা নিয়ো।
পথ-চাওয়া মোর দিনগুলিরে
রেখে গেলাম নদীর তীরে,
আবার যদি আস ফিরে–
তুলে গলায় দিয়ো॥
নিভে এল পরান-প্রদীপ
পাষাণ-বেদির তলে
জ্বালিয়ে তারে রাখব কত
শুধু চোখের জলে।
তারা হয়ে দূর আকাশে
রইব জেগে তোমার আশে,
চাঁদের পানে চেয়ে চেয়ে
আমারে স্মরিয়ো॥
নদী নিয়ে লেখা বিভিন্ন কবিতা, Various poems written on the river :
জীবন নদীর তীরে….
অধীর হয়ে বসে আছি,
– ক্লান্ত মাঝি
জীবন নদীর তীরে ।
নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকি,
কেউ আসেনি ফিরে।
কেউ ধরেনি নৌকোর ঐ হাল,
কেউ তোলেনি পাল ।
অপেক্ষাতেই শেষ হয়ে যায়,
বিকেল আর সকাল।
উজান ভাটির নিত্য খেলায়,
ছেড়েছি আমি ঘর,
ঝাপসা চোখে শুধুই দেখি,
শূন্য বালুচর।
বিপাকে পড়ে আমি যেন আজ,
ভূগছি দোটানায়,
কে বা এসে বলবে আমায়,
ও মাঝি চল অজানায়।
নারী-নদী-প্রেম
আমি আনাড়ি প্রেমিক!
– অবিরুদ্ধ মাহমুদ
নদী ও নারীর কাছে প্রেম শিখি…
ঈশ্বরের অদৃশ্য হাতে গড়া আশ্চর্য মাটির পুতুল
তুমি কেবল হৃদয় ছুঁয়ে দিতে জানো।
নদীর জলে হিজলের ফুল
সে ফুল শোভা পায় নারীর চুল;
নদী তুমি আজও নারী বুঝনি!
নারী বুঝলে প্রেমও বুঝতে….
যে জলে আগুন জ্বলে
প্রেমের সুধা পান করে সুবর্ণ প্রভা;
যে জন প্রেমে পড়ে সেই জানে কেবল,
নারী-নদী-প্রেম,আর জলের মিতালী।।
নদী আর ঢেউ
ঢেউরে তোর কষ্ট কিসের
– কাজী ফাতেমা ছবি
নদীরে খুলে বল
নদী তোর নয় কি কেউ
চোখে ঝরাস জল!
নদী বিনে তোর আকাশে
কালো মেঘে ছায়
তাই কি তুই অভিমানে
একা বসে নায়।
নদী ছাড়া থাকবি কই
কে আর আছে তোর
নদীর সাথেই জনম ধরে
বাঁধা মায়াডোর।
আঁচড়ে পড়িস নদীর বুকে
যখন ইচ্ছে তখন
অকূলে কূল ভালবাসা
পাবি মনের মতন।
নদী ও নৌকা
গগন তলে নদীর জলে
– শাহাদাত হোসেন
তরী যায় ভেসে
আপন মনে দাঁড় টানে
মাল্লা হেসে হেসে।
তরীর গায়ে আছড়ে পড়ে
ভাঙছে নদীর জল
নিজ স্বরে শব্দ করে
ছলাৎ ছলাৎ ছল।
শেষ কথা, Conclusion :
নদীর সৌন্দর্যে পাগল প্রায় এদেশের মানুষের অনুভূতির কোন শেষ নেই ।নদীর সৌন্দর্যের অবারিত ধারায় বাঙালির কতশত স্বপ্ন বোনা।বলাই বাহুল্য যে নদীর সাথে মানুষের একটি আধ্যাত্মিক সংযোগ রয়েছে, আর এই সংযোগের মাধ্যমেই রচিত হয়েছে নদী নিয়ে লেখা কবিতাগুলো। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা কবিতাগুলো আপনাদের মনোগ্রাহী হয়েছে। নদী নিয়ে লেখা কবিতা সম্পর্কিত এই প্রতিবেদন আপনাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এবং বন্ধু বান্ধবের সাথে অবশ্যই শেয়ার করবেন।