নতুন সূচনার আশায়শরৎ ও হেমন্তের পর মানুষ শীতকে বরণ করে নেয়। শীতকালে ভোরবেলা সবকিছু কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে, দেখলে মনে হবে যেন গাছগুলোও ঘুমিয়ে আছে। সূর্যের কিরণের দেখা পেয়ে পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশির কণাগুলো ঝিলিক মেরে ওঠে। এমনকি সূর্যও যেন এই ঋতুতে কুয়াশা ও মেঘের আড়ালে থেকে বিশ্রাম নেয় বলে মনে হয়। শীতের প্রকৃতির আমেজে মূখরিত হয়ে বহু কবি রচনা করেছেন শীতের কবিতা। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা বিখ্যাত কিছু কবির লেখা শীতের কবিতা তুলে ধরবো।
শীত নিয়ে বিখ্যাত কবিদের লেখা কবিতা, Poems written by famous poets about winter :
শীত
পাখি বলে ‘আমি চলিলাম’,
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না’,
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না’।
কিশলয় মাথাটি না তুলে
মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি,
সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস
টানি দিল মুখের উপরি।
পাখি কেন গেল গো চলিয়া,
কেন ফুল কেন সে ফুটে না।
চপল মলয় সমীরণ
বনে বনে কেন সে ছুটে না।
শীতের হৃদয় গেছে চলে,
অসাড় হয়েছে তার মন,
ত্রিবলিবলিত তার ভাল
কঠোর জ্ঞানের নিকেতন।
জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ,
ফুলের যৌবন পরিমল,
মলয়ের বাল্যখেলা যত,
পল্লবের বাল্য কোলাহল-
সকলি সে মনে করে পাপ,
মনে করে প্রকৃতির ভ্রম,
ছবির মতন বসে থাকা
সেই জানে জ্ঞানীর ধরম।
তাই পাখি বলে ‘চলিলাম’,
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না’।
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না’।
আশা বলে ‘বসন্ত আসিবে’,
ফুল বলে ‘আমিও আসিব’,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব’,
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব’।
বসন্তের নবীন হৃদয়
নূতন উঠেছে আঁখি মেলে-
যাহা দেখে তাই দেখে হাসে,
যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে।
মনে তার শত আশা জাগে,
কী যে চায় আপনি না বুঝে-
প্রাণ তার দশ দিকে ধায়
প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে।
ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে-
পাখি গায়, সেও গান গায়-
বাতাস বুকের কাছে এলে
গলা ধ’রে দুজনে খেলায়।
তাই শুনি ‘বসন্ত আসিবে’
ফুল বলে ‘আমিও আসিব’,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব’,
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব’।
শীত, তুমি হেথা কেন এলে।
উত্তরে তোমার দেশ আছে-
পাখি সেথা নাহি গাহে গান,
ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে।
সকলি তুষারমরুময়, সকলিআঁধার জনহীন-
সেথায় একেলা বসি বসি
জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।
শীত এলে মনে হয়
মাঠ থেকে উঠে ওরা এখন গোলায় শুয়ে আছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সোনালী ফসল, কত রোদ ও বৃষ্টির স্বপ্ন যেন
স্নেহ লেগে আছে
লাউমাচায়, গরু ও গরুর ভর্তা সবান্ধব পুকুরের পাশে
মুখে বিশ্রামের ছবি, যদিও কোমরে গ্যাঁটে ব্যাথা ।
শীত এলে মনে হয়, এবার দুপুর থেকে রাত
মধুময় হয়ে যাবে, যে রকম চেয়েছেন পিতৃপিতামহ
তাদের মৃত্যুর আগে ভেবেছেন আর দুটো বছর যদি…
শীত এলে মনে হয়, এই মাত্র পার হল সেই দু’বছর
এবার সমস্ত কিছু……
শীত চলে যায়, বছর বছর শীত চলে যায়,
সে দুটি বছর আর কখনো আসেনা ।
ওগো শীত
ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার উত্তরবায়ু দুরন্ত দুর্দম অরণ্যের বক্ষ হানে।
বনস্পতি যত থর থর কম্পমান,
শীর্ষ করি নত আদেশ-নির্ঘোষ তব মানে।
“জীর্ণতার মোহবন্ধ ছিন্ন করো’ এ বাক্য তোমার
ফিরিছে প্রচার করি জয়ডঙ্কা তব দিকে দিকে।
কুঞ্জে কুঞ্জে মৃত্যুর বিপ্লব করিছে বিকীর্ণ
শীর্ণ পর্ণ রাশি রাশি
শূন্য নগ্ন করি শাখা,
নিঃশেষে বিনাশি অকাল-পুষ্পের দুঃসাহস।
হে নির্মল, সংশয়-উদ্বিগ্ন চিত্তে পূর্ণ করো বল।
মৃত্যু-অঞ্জলিতে ভরো অমৃতের ধারা,
ভীষণের স্পর্শঘাতে করো শঙ্কাহারা,
শূন্য করি দাও মন;
সর্বস্বান্ত ক্ষতি অন্তরে ধরুক শান্ত উদাত্ত মুরতি,
হে বৈরাগী।
অতীতের আবর্জনাভার, সঞ্চিত লাঞ্ছনা
গ্লানি শ্রান্তি ভ্রান্তি তার সম্মার্জন করি দাও।
বসন্তের কবি শূন্যতার শুভ্র পত্রে
পূর্ণতার ছবি লেখে আসি’,
সে-শূন্য তোমারি আয়োজন,
সেইমতো মোর চিত্তে পূর্ণের আসন
মুক্ত করো রুদ্র-হস্তে;
কুজ্ঝটিকারাশি রাখুক পুঞ্জিত করি প্রসন্নের হাসি।
বাজুক তোমার শঙ্খ মোর বক্ষতলে নিঃশঙ্ক দুর্জয়।
কঠোর উদগ্রবলে দুর্বলেরে করো তিরস্কার;
অট্টহাসে নিষ্ঠুর ভাগ্যেরে পরিহাসো;
হিমশ্বাসে আরাম করুক ধূলিসাৎ।
হে নির্মম, গর্বহরা, সর্বনাশা, নমো নমো নমঃ।
শীত নিয়ে লেখা বিভিন্ন কবিতা, Different poems about winter :
টনটনে শীত
টনটনে কনকনে
– শাহজাহান মোহাম্মদ
এলো আবার শীত
কুয়াশায় মাখা বন
শিশিরের গীত।
তরতাজা সবজি
ভরে গেছে ক্ষেতে
ফুলে ফুলে মধু খায়
মৌমাছি মেতে।
ভিনদেশি পাখিদের
জমে ওঠে খেলা
কৃষাণীর শুরু হয়
ধান ভাঙার মেলা।
খেঁজুরের রসে রসে
চারিদিকে ঘ্রাণ
পাখিদের কলতানে
জেগে ওঠে প্রাণ।
দাদা-দাদি নানা-নানি
গায়ে চাদর মুড়ে
খায় তারা পিঠা-পুলি
খেঁজুরের গুড়ে।
কনকনে শীতে
কনকনে শীতে ঘাসের উপর শিশির ঝরে,
– গোলাপ মিয়া
সূর্যের আলোয় যেন মুক্তার মত ঝলমল করে।
কনকনে শীত সকালে একচুমুক খেজুরের রসে,
ষাট বছরের বুড়োর মতই কাপুনি যেন উঠে!
কনকনে শীতে চিতই-ভাপা ঘ্রাণে,
রাস্তার মোড়ে পিঠার দোকানে ভিড় জমে।
কনকনে শীতে নদীমতৃপ্রায় যৌবন হারায়,
আাকাশ পানে চেয়ে থাকে বৃষ্টির আাশায়!
কনকনে শীতে কড়কুঠু দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে,
গ্রামের জোয়ান-বুড়োরা গাল-গল্প করে!
কনকনে শীতে দিনমজুরের কষ্ট বাড়ে,
বস্ত্রহীনতার প্রকোপে রোগবালাই ধরে!
কনকনে শীতে দিনের পর দিন চলে যাই,
পাইনা খুজে সূর্যের দেখা!
কনকনে শীতে কুয়াশায় চাদর মুড়িয়ে,
পথিক চলে গ্রাম বাংলার মেঠো পথে!
এই শীতে সেই শীত…
কনকনে শীত চেপে ঘন কুয়াশা
– কবির হোসাইন
যত দূর চেয়ে দেখি আঁধারের মাখামাখি
তুমি আমি কোথা আছি…মাঝে ধোঁয়াশা।
শৈত্য প্রবাহে ছোঁয়া বৃষ্টি ফোঁটার
এই ভোরে নাম নেই সূর্য্য ওঠার
খানিকটা উম্ পাই কোথায় গেলে
কি করে বাঁচবে আজ পথের ছেলে
প্রকৃতি বিরুপ রুক্ষ্ম কি আর করা
খড় কুটো খুঁজে এনে আগুন ধরা
আলস্য তুলছে হাই অফিস পাড়ায়
কৃষক মজুর কাজে দু’হাত বাড়ায়
কিছু আশা ভালবাসা কিছু নিরাশা…
কোথায় হারালো সেই শীতের সকাল?
চিরায়ত বাংলায় উথাল পাথাল
নেই মন নেই ধন হাহাকার মিলে
অতিথি পরায়নতা খেয়েছে যে গিলে
সুমিষ্ট খেজুর রস; মাটির হাড়ি
পিঠার আমেজে মত্ত কুটুম বাড়ি
ভেজানো চিতই পিঠা ফিরনি পায়েস
মুড়ি দিয়ে খাওয়া আহা! বড়ই খায়েস
এই অভাগা সময়ে তার করি দুরাশা…
এই কালো এই আলো মাঝে কুয়াশা
প্রকৃতির রং চটা আঁধারের ঘন ঘটা
সবকিছু ঠিক বুঝি; নেই ভরসা
তারপরও ভাল আছি …মাঝে ধোঁয়াশা।।
শীতের আগমন
হিম হিম বইছে মৃদ হাওয়া শীতের কি কাঁপন,
– বিজন অধিকারী
বছর ঘুরে আবার এলো শীতের এই আগমণ।
শষ্য ফুলের মিলন মেয়লায় প্রকৃতি অপরূপ সাজে,
কুয়াশার ঐ চাদরে ঘেরা শিশির ভেজা ঘাসে।
গাছি কাটে খেজুর গাছ লয়ে আনন্দে উচ্ছাস,
শিশু, কিশোর খেজুর রসে মেতে ওঠে উল্লাস।
পৌষ, মাঘে বাড়িতে বাড়িতে হরেক মজার পিঠা,
শীতের বেলায় পিঠা পুলি লাগে বড্ড মিঠা।
পথ শিশু, গরিব দুখি শীতের ভরা যৌবন,
শীত বস্ত্রের অভাবে তারা করে মানবেতর জীবন।
গরীব দুখি অনাথ শিশুর গরম কাপড়ের সঙ্কট,
রাখবো না তাদের শীত কষ্টে বাঁধবো সবাই জোট।
শীতের আগমন
শীত এসেছে বাটে বাটে
– আহমাদ কাউসার
শীত এসেছে হাটে
মটরলতায় শীত এসেছে
ফসল ভরা মাঠে।
শীত এসেছে বনবাদাড়ে
ছোট পাখির বাসায়
শীত এসেছে কুঁড়েঘরে
উঁচু দালানকোটায়।
শীত এসেছে পল্লিমেয়ের
উড়ো উড়ো মনে
হলুদ গাঁদা ফুল গুঁজে দেয়
কালো চুলের সনে।
শীতের আগমন
শীতের আগমনে প্রকৃতি সাজে,
– তাহমিনা আক্তার বৃষ্টি
কুয়াশা পড়ে থাকে পাতার ভাঁজে,
সবুজ ঘাস হয়ে যায় আরো যেন সবুজ,
সন্ধ্যে না হতেই শুরু হয় কুয়াশার বুঝ।
সূর্য মামা উদয় হয় সদায় লাজুক হয়ে,
সারাদিন আলো দিয়ে বিদায় নেয় ক্লান্তি বয়ে, রাত মানেই শীতের তাণ্ডব, পেঁচানো গরম কাঁথা
সকাল সকাল পরে কুয়াশার ঘন ঘন ফোঁটা।
সকালের ওই মিষ্টি রোদে আরাম লাগে খুব,
গোসল করার সময় মন বলে রোদ থাকতেই দেই ডুব,
গোসল শেষে নতুন বেশে রোদে গিয়ে বসি,
একটুখানি বসতে না বসতে সূর্য দেয় বিদায়ের হাসি।
শীত মানেই তরতাজা শাকসবজি সমাহার,
শীত মানে প্রকৃতির এক অপরূপ বাহার,
শীত মানে তিলের টপি আর মোয়া খাওয়ার ধুম,
শীত মানেই খেয়ে দেয়ে আরামে দেই ঘুম।
শীতের মাঝে ভালো লাগা কাজ করে সদাই,
শীত আমার ভালোলাগা তাই, চাই না হোক বিদায়,
শীত মানে হরেক রকম পিঠার সমাহার,
শীত মানে মন্ডা মিঠাই আরো কত কিছুর বাহার।
শেষ কথা, Conclusion :
শীতের দিনগুলোতে অনেকেই কুয়াশার ছবি, শিশিরভেজা ঘাসের ছবি ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে পরিবেশন করতে পছন্দ করেন। সেই ছবির সাথে যদি একটি শীতের কবিতা লিখে দেওয়া যায় তবে তো পোস্ট টি আরো মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। আশা করি যারা অনলাইনে শীতের কবিতা খোঁজ করে থাকেন তাদের উপরে উল্লেখিত কবিতাগুলোর মাধ্যমে অনেকটা সহায়তা হবে। প্রতিবেদনটি যদি আপনাদের মনোগ্রাহী হয় তবে অবশ্যই আপনার পরিবার ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে শেয়ার করে নেবেন।