শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে “আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে”। একথাটির অর্থ অনেকেই হয়তো জানেন। তবে যাদের এর অর্থ জানা নেই তারা আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে জেনে নিতে পারবেন।
“আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে” মূলভাব, “Set an example yourself before teaching others” original meaning :
কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির জীবনাচরণের মধ্যে যা নেই, তা নিয়ে সেই ব্যক্তি অন্যকে উপদেশ দেওয়া ঠিক হবে না। অন্যকে কোনো কিছু নিয়ে উপদেশ দেওয়ার আগে নিজেকে তা পালন করে দেখাতে হবে। এর ফলে যাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, সেই ব্যক্তিও তা পালন করতে আন্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ হবে।
“আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে” সম্প্রসারিত ভাব, “Set an example yourself before teaching others” Expanded view :
কাউকে উপদেশ দেওয়া হয়তো খুব সহজ, কিন্তু কারও উপদেশ পালন করা অনেক কঠিন। বিশেষ করে যদি যে ব্যক্তি উপদেশ দিচ্ছে, সে নিজে তা পালন না করে, তখন উপদেশ-গ্রহণকারীর কাছে সেই উপদেশের গুরুত্ব থাকে না।
অন্যদিকে যে ব্যক্তি উপদেশ দানকারী, সে যদি সেই নির্দিষ্ট উপদেশ নিজ জীবনেও পালন করে দেখান, তবে উপদেশ-গ্রহণকারী তার থেকে উপদেশটি পালন করার দৃষ্টান্ত পেয়ে যান, যা তার জীবনাচরণে বিশেষ তথা সক্রিয় প্রভাব ফেলে।
আমাদের সমাজে সাধারণত দেখা যায় যে; ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক, জ্ঞানী ব্যক্তি বা জীবনে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তদের তরফ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ-বাণী বর্ষিত হয়ে থাকে। এদের দেওয়া এইসব উপদেশগুলি মানুষ পালন করতে কোনো দ্বিধা করে না।
তবে সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপদেশ হিসেবে বর্ষিত কথাটুকু তারা নিজেদের জীবনেও সত্যিই অনুসরণ করেন কি-না, সেদিকে সতর্ক থাকতে হয়। অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে; আমাদের সমাজে অনেক মানুষ থাকে, যারা বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতে খুব পটু।
কিন্তু তাদের প্রদান করা ওইসব উপদেশ তারা নিজেরাই কখনো পালন করতে অভ্যস্ত নয়। এর প্রভাব স্বরূপ, তখন উপদেশগুলো উপদেশ-গ্রহণকারীর কাছে গুরুত্বপূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না।
এই ব্যাপারে,উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নির্দিষ্ট একজন লোক যদি নিয়মিত ধূমপান করে থাকে, আর অন্যদিকে সে অন্যান্যদের ধূমপান করতে নিষেধ করে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য উপদেশে বলে অনুভব হয় না।
তাই কখনো কোনো একটা ভালো কাজ করার জন্য অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার আগে সেই বিষয়ের ক্ষেত্রে উপদেশদাতাকেই ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে অভ্যস্ত হতে হবে। এভাবে উপদেশ-গ্রহণকারী উপদেশের পাশাপাশি উপদেশ পালনের নজিরও গ্রহণ করতে পারে এবং তার উপদেশের মাধ্যমে সে নিজের পাশাপাশি অপরকেও উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
‘অন্যকে পরামর্শ প্রদান’, Giving advice to others :
আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে একটি সাধারণ বিষয় পরিলক্ষিত হয়, সেটি হল ‘অন্যকে পরামর্শ প্রদান’। এই প্রবণতা প্রায় সকলের মধ্যেই কম বেশি আছে। সবাই কেবল অন্যের দোষ খুঁজতেই ব্যস্ত, সকলেরই যেন অন্যের সংশোধন চাই; কিন্তু নিজের দিকে ফিরে তাকাবার সময় কারও কাছে নেই।
নিজের দোষ সহজে কারও চোখে পড়ে না, তাই নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা কেউ করে না। অপরের পিছে লেগে থেকে, তাদের দোষ ধরার মাধ্যমে আমরা তাদের নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ করে দেই, কিন্তু নিজেরা অনুন্নত রয়ে থাকি। এর কারণ নিজের দোষ তো কেউ দেখছে না, ফলে সংশোধন করার প্রশ্নই আসে না। এতে এক অচলায়তনের সৃষ্টি হয় যায়; যার প্রভাবে অসংশোধনের অমোঘনীয় চক্রে আটকা পড়ি আমরা।
তবে এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হতে পারে আমাদের সমাজে প্রচলিত এই পুরাতন প্রবচনের অনুসরণ, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’; অর্থাৎ অপরকে কিছু করার উপদেশ দেয়ার আগে নিজে তা করো কি না সেটা দেখা উচিত।
যে কাজ আপনি নিজে করেন না তা অন্য কাউকে করার জন্য পরামর্শ দেওয়া উচিত নয়। যেকোনো কাজ করার জন্য কাউকে বলার ক্ষেত্রে উপদেশ প্রদানের পূর্বশর্ত হলো নিজে সেই কাজের যথার্থ অনুশীলন করা। নিজে যদি সে কাজ কেউ করে দেখাতে না পারে তবে তার উপদেশ অর্থহীন হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র নিজে করে অপরকে শিক্ষা দিলেই, সেই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়।
সর্বোত্তম উপদেশ দাতা, The best advice giver :
ভালো মানুষ সেজে কাউকে কোনো বিষয়ে উপদেশ দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু অনেক সময় নিজের কাছেই সেই কাজ কঠিন মনে হয়।
আপনি নিজে কোনো ব্যাপারে না জেনে সে-সম্পর্কে কাউকে উপদেশ দেওয়ার কাজ করতে যাবেন না। এর কারণ, সমাজে সেই উপদেশদাতাই সর্বোত্তম, যিনি নিজে যা পালন করেন, অন্যকেও তা পালন করতে বলেন। যা আপনি বোঝেন না, সেই বিষয়ে যদি জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে সেটার মানে নিজের অজ্ঞতাই জাহির করা।
এ নিয়ে কবি লিখেছেন,
“অজস্র জ্ঞানী, জ্ঞানেতে মাতেন,
ভরে দু’হাতে, উপদেশ বাটেন।
জিহ্বায় নেই হাড়! কথা-বর্তায়,
সহজে অনর্গল, সব বকা যায়!
রসনা স্বাধীন, মুক্ত বাঁধাহীন –
প্রগল্ভ বাক্য বল- প্রতিদিন!”
অন্যকে ভালো মানুষ হওয়ার উপদেশ দেওয়ার আগে আমাদের সকলেরই উচিত নিজে একজন ভালো মানুষে পরিণত হওয়া। একইভাবে দেখতে গেলে, উপদেশ দানে যিনি যোগ্য নেতা হতে চান তাকে সর্ব প্রথম নিশ্চিত করতে হবে যে, তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলি রয়েছে। বস্তুত নিজ জীবনে যদি মহৎ গুণাবলি অর্জন করতে পারেন, তবেই অন্যকে মহৎ হওয়ার উপদেশ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায়।
আচরি ধর্মের গুরুত্ব, Importance of Achari Dharma :
- আচরি ধর্ম মানুষকে নিজের ভেতরের দুর্বলতা দূর করতে এবং ভালো গুণাবলী বিকশিত করতে সাহায্য করে।
- শিশুদের ছোটবেলা থেকেই আচরি ধর্ম শেখানো উচিত, এটি তাদের ভালো চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুরা বাড়ির প্রাপ্তবয়স্কদের দেখে শেখে। তাই, শিশুদের আচরি ধর্ম শেখাতে হলে, আমাদের নিজেদের জীবনে সেই নীতিগুলি অনুশীলন করতে হবে।
- আমাদের উচিত আমাদের নিজস্ব নৈতিক আচরণ ও মূল্যবোধ অন্যদের শেখানোর চেষ্টা করা। আমাদের আচরণ অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং তাদেরও একই নীতি অনুসরণ করতে উৎসাহিত করতে পারে। তাই নিজেকে সেইভাবে প্রস্তুত করা উচিত যেন অন্যরা সঠিক অনুপ্রেরণা পায়।
- নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতিমালা অন্যদের সাথে ভাগ করে নেয়ার এবং তাদেরকে সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করতে অনুপ্রাণিত করাই হল “আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে” বাক্যের মূল অর্থ।
- “আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে” বাক্যটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে ধর্মের প্রকৃত অর্থ কেবল আচার-অনুষ্ঠান পালন করা নয়, বরং নৈতিক জীবনযাপন করা এবং অন্যদেরকেও তা করতে অনুপ্রাণিত করা।
শেষ কথা, Conclusion :
কখনো একে অপরের খুঁত অন্বেষণ না করে, বরং আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ আত্ম-উন্নয়নে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। প্রথমে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিয়ে, নিজের সংশোধন দরকার, তারপর অন্য কাউকে পরামর্শ বা উপদেশ দেওয়া যোগ্য হবে।
অন্যের সংশোধনে না লেগে, আমরা যদি সবাই স্ব দায়িত্ব- কর্তব্য পালনে আরো সচেষ্ট হই, তবেই আমরা একটা উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। আশা করি আজকের এই আলোচনার মাধ্যমে আপনারা “ আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে” প্রবচনের মূল অর্থ বুঝতে পেরেছেন।