প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আগুনে পুড়ছে একটি বিশাল পণ্যবাহী জাহাজ, যেখানে ছিল প্রায় ৩ হাজার নতুন গাড়ি। যে সমুদ্রে আগুন লাগলে তা কতটা জটিল ও নাছোড়বান্দা হতে পারে এই ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করল। ‘মর্নিং মিদাস’ নামের পণ্যবাহী জাহাজটি আগুনে জ্বলছে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে। কোস্ট গার্ডের খবর অনুযায়ী, জাহাজের পেছনের অংশে শুরু হওয়া আগুন এখন একাধিক ডেক ভেদ করে পুরো জাহাজটিকে গ্রাস করেছে।
জাহাজ উদ্ধারের কাজ ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে। ‘গ্রেচেন ডানল্যাপ’ নামের একটি টাগবোট উদ্ধারকারী দল নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে এবং ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ শুরু করেছে, আরও দুটি জাহাজ আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই অভিযানে যোগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাহাজের ব্যবস্থাপক জোডিয়াক মেরিটাইম, রিজলভ মেরিনকে উদ্ধার কাজের জন্য দায়িত্ব দিয়েছে। এদিকে, মার্কিন কোস্ট গার্ডের তথ্য অনুযায়ী, ৬০০ ফুট লম্বা এই গাড়ি বহনকারী জাহাজটি ঘণ্টায় প্রায় ১.৮ মাইল বেগে উত্তর-পূর্ব দিকে ভেসে চলেছে।
এই জাহাজে থাকা গাড়ির মোট সংখ্যা, পেট্রোল, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড মডেলের সাধারণ বিবরণ ছাড়া কোন গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার গাড়ি ছিল, তা এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়নি। জাহাজটি চীন থেকে মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল যখন আগুন লাগে।
কোস্ট গার্ডের সেভেনটিনথ ডিস্ট্রিক্টের কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল মেগান ডিন বলেছেন, জনসাধারণ, উদ্ধারকারী এবং ঐ এলাকায় কাজ করা জাহাজের কর্মীদের নিরাপত্তা কোস্ট গার্ডের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আমরা জোডিয়াক মেরিটামের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছি যাতে আগুন মোকাবেলা করার এবং পরিবেশের উপর সম্ভাব্য যে কোনো প্রভাব কমানোর জন্য একটি নিরাপদ ও কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা যায়।
মার্কিন কোস্ট গার্ড এই ঘটনা সম্পর্কে আরও জানিয়েছেন, আলাস্কার আডাক থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দক্ষিণে বুধবার এই ঘটনা ঘটেছিল। ৬০০ ফুট লম্বা, লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এই পণ্যবাহী জাহাজে মোট ৩,০৪৮টি গাড়ি ছিল বলে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা একটি যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত। এর মধ্যে ৭০টি সম্পূর্ণ ইলেকট্রিক গাড়ি এবং হাইব্রিড-ইলেকট্রিক গাড়ি ৬৮১টি ছিল।

এসব ছাড়াও কোস্ট গার্ড জানিয়েছে, যে আগুনের অবস্থা এখনও অনিশ্চিত, যদিও জাহাজ থেকে এখনও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। রিয়ার অ্যাডমিরাল মেগান ডিন বলেছেন, আমাদের উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে, আমাদের কর্মীরা জাহাজের ব্যবস্থাপক জোডিয়াক মেরিটামের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছে জাহাজের পরিস্থিতি নির্ধারণের জন্য। আমরা কাছাকাছি থাকা তিনটি জাহাজের আত্মত্যাগের মনোভাবকে কৃতজ্ঞতা জানাই যারা উদ্ধারে সহায়তা করেছে এবং মোটর ভেসেল কসকো হেলাসের কর্মীদের ধন্যবাদ জানাই, যারা ২২ জনের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে।
ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রি হয়তো অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী গতি পায়নি, কিন্তু আরও একটি জাহাজের আগুনে এই খবর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ইলেকট্রিক গাড়ি সত্যিই দাহ্য। যখন আগুন লাগে কার্গো জাহাজটি এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকার দিকে যাচ্ছিল, ফলে কর্মীদের প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে জাহাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয় এবং হাজার হাজার নতুন গাড়ি জাহাজের ভিতরেই থেকে যায়।
মে মাসের ২৬ তারিখে চীন থেকে মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ‘মর্নিং মিদাস’ নামের জাহাজটি। এতে প্রায় ৩,০০০ গাড়ি ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৮০০টি ইলেকট্রিক গাড়ি ছিল। ১৯ দিনের যাত্রার অষ্টম দিনে, ৩ জুন মধ্যরাতের ঠিক পরে (ইএসটি সময় সন্ধ্যা ৭টা), একটি ডেক থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়।
ইউকে-ভিত্তিক জাহাজ মালিক জোডিয়াক মেরিটাম, যারা জাহাজটি পরিচালনা করে, তারা পরে নিশ্চিত করে যে আগুন জাহাজের সেই অংশে শুরু হয়েছিল যেখানে ইলেকট্রিক গাড়ি রাখা ছিল।
মার্কিন কোস্ট গার্ডের সাথে যোগাযোগ করার পর ২২ জন ক্রু সদস্য জাহাজ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং লাইফবোটে লাফিয়ে পড়েন। পরে তাদের কাছাকাছি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ উদ্ধার করে। লেখালেখির সময়ও আগুন জ্বলছিল, তাই জাহাজে থাকা হাজার হাজার গাড়ির অবস্থা অজানা।
এই প্রথম নয় যে ইভি বহনকারী একটি জাহাজ সমুদ্রে আগুনে পুড়েছে। তিন বছর আগে, আরেকটি জাহাজ, যেখানে পোর্শে, বেন্টলি এবং ল্যাম্বরগিনি মডেল সহ ৪,০০০ গাড়ি ছিল, আটলান্টিক মহাসাগরে আগুনে পুড়ে যায়। ফেলিসিটি এসকে নিরাপদে টেনে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে জ্বলতে থাকার পর জাহাজটি আজোরসের কাছে উল্টে যায় এবং ডুবে যায়।
ঐ ঘটনাতেও ২২ জন ক্রু সদস্যকে বাঁচানো গিয়েছিল, কিন্তু ভিডব্লিউ গ্রুপ বলেছিল যে বীমা কোম্পানিকে হারানো গাড়ির জন্য ১৫৫ মিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করতে হবে। ল্যাম্বরগিনি এমনকি একটি গ্রাহকের গাড়ির ক্ষতিপূরণ দিতে তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া অ্যাভেন্টাডরের উৎপাদন আবার শুরু করেছিল।
নরওয়ের হ্যাভিলা কাইস্টরুটেন-এর মতো কিছু শিপিং কোম্পানি এখন ইলেকট্রিক গাড়ি বহন করতে অস্বীকার করছে, কারণ তারা এটিকে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে। কিন্তু ইভিগুলো ভবিষ্যতে গাড়ির বাজার দখল করতে চলেছে, তাই এই গাড়িগুলো কোনো না কোনো উপায়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে হবে, এবং জাহাজীকরণই একমাত্র বাস্তবসম্মত পদ্ধতি।