বেঙ্গালুরুর শহুরে চাকরিজীবনের ঝলমলে জগৎ ছেড়ে এক অন্যরকম জীবনের খোঁজে পথ ধরেছিলেন দিবাকর চান্নাপ্পা। ইসরোর প্রাক্তন প্রকল্প বিজ্ঞানী দিবাকর এখন কর্ণাটকের একজন সফল জৈব খেজুর চাষি, যার খামার থেকে বার্ষিক আয় ১৫ লক্ষ টাকারও বেশি।
শিকড়ে ফেরা: শহর ছেড়ে গ্রামের পথ
গ্রামীণ কর্ণাটকের বেগুর গ্রামে জন্ম দিবাকরের। বাবা সবসময় চেয়েছিলেন ছেলে পড়াশোনায় এগিয়ে যাক, কৃষিকাজের কষ্ট যেন পোহাতে না হয়। তাই ব্যাঙ্গালোরে পাঠানো হয় তাকে। পরবর্তীতে দিবাকর সমাজকর্মে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থায় কাজের পর ইসরোতে একজন প্রকল্প বিজ্ঞানী হিসেবে নিযুক্ত হন।

কিন্তু ২০০৯ সালে বাবার স্ট্রোকের পর সবকিছু বদলে যায়। বাবার পাশে থাকতে শহরের চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। এখান থেকেই শুরু হয় নতুন পথচলা।
‘ওয়ান স্ট্র রেভোলিউশন’ এবং অনুপ্রেরণার উত্স
বাবার সঙ্গে কাটানো সময়ের মধ্যেই দিবাকর জাপানি কৃষক মাসানবু ফুকুওকার লেখা ‘ওয়ান স্ট্র রেভোলিউশন’ পড়েন। এই বই থেকেই পান নতুন অনুপ্রেরণা। মাত্র চার দিন পড়েই সাহস করে তিনি বাবার গোপনে কেনা জমিতে যান। সেখান থেকেই শুরু কৃষিজীবনের অধ্যায়।
খেজুর চাষের অনন্য যাত্রা
প্রথমদিকে দিবাকরও অন্যান্য কৃষকদের মতো বাজরা, তুর ডাল ও ভুট্টা চাষ করেন। লাভের অঙ্ক ছিল নগণ্য। পরিবারের অনেকে হতাশ হয়েছিলেন তার এই সিদ্ধান্তে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, তিনি এমন কিছু চাষ করবেন যা তাকে আলাদা পরিচিতি দেবে। মনে পড়ে এক কৃষি মেলায় দেখা তামিলনাড়ুর এক খেজুর চাষির কথা।
খেজুর গাছ মানেই মরুভূমি—এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে দিবাকর শুরু করেন খেজুর চাষ। প্রায় ছয় মাস খোঁজার পর সেই চাষির কাছে পৌঁছে যান এবং শেখেন খেজুর চাষের পদ্ধতি।
৪.৫ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ ও লোকজনের কটাক্ষ
প্রাথমিকভাবে ৩,০০০ টাকা দিয়ে কেনেন ১৫০টি খেজুর চারা। এরপর প্রায় ৪.৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তোলেন খামার। মরুভূমি ছাড়া খেজুর চাষ?—স্থানীয়রা হাসাহাসি শুরু করেন, কেউ কেউ তো তাঁকে পাগল বলেও কটাক্ষ করেন।
কিন্তু দিবাকর থামেননি। বিশেষ পদ্ধতিতে ২×২ ফুট গর্ত খুঁড়ে নদীর বালি, নিম ও ক্যাস্টর কেক, ভার্মিকম্পোস্ট এবং পঞ্চগব্য ব্যবহার করে মাটিকে প্রস্তুত করেন খেজুর চাষের উপযুক্ত করে।
ফল ও সাফল্য: বিশ্বাসকে বাস্তব করলেন দিবাকর
সাড়ে চার বছর পর প্রথম ফুল দেখতে পান। তার খুশির অন্ত ছিল না। প্রথমবার আড়াই একর জমি থেকে ৮০০ কেজি খেজুর পান, যা পরে পাঁচ টনে উন্নীত হয়। প্রতি কেজি খেজুরের দাম ৩৭৫ টাকা। বর্তমানে তিনি প্রতি একরে ৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করেন।

সম্মান ও অনুপ্রেরণা
দিবাকরের সফলতা ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যমে। সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর শ্বশুরও এসে তাঁর খামার দেখেন। দক্ষিণ ভারতে জৈব পদ্ধতিতে খেজুর চাষ শুরু করা প্রথম কৃষক হিসেবে তিনি পরিচিতি পান।
চ্যালেঞ্জ ও অভ্যন্তরীণ শান্তির সন্ধান
এই যাত্রাপথ কখনোই সহজ ছিল না। শহরের জীবন ছেড়ে, ইসরোর চাকরি ছেড়ে, গ্রামের কৃষক জীবন বেছে নেওয়াটা আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। প্রথম চারটি ফসলের মৌসুমে তিনি উপার্জনের থেকে বেশি ক্ষতিই দেখেছেন।
তবুও, আজ দিবাকর বিশ্বাস করেন তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। “কৃষিকাজে কোনও নিশ্চিত লাভ নেই, এটা রিয়েল-এস্টেট নয়। কিন্তু এর মধ্যেই আমি পেয়েছি অভ্যন্তরীণ শান্তি, যা শহরের চাকরিতে খুঁজে পাইনি,” বলেন তিনি।
দিবাকর চান্নাপ্পার জীবন প্রমাণ করে, সাহস আর ধৈর্য থাকলে কোনও পথই অসম্ভব নয়। শহুরে চাকরি ছেড়ে, কষ্টের পথে হেঁটে তিনিই প্রমাণ করেছেন—মাটি, পরিশ্রম আর ভালবাসা একসঙ্গে থাকলে সাফল্য আসবেই।