ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক সীমান্তগুলির মধ্যে একটি। প্রায় ৭৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং ২,৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত মিলে দুই দেশের মোট ৩,৩২৩ কিলোমিটার সীমানা। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতি রেখা হিসেবে তৈরি হওয়া এই LoC, ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক নামকরণ লাভ করে।
সংঘাতের শিকার সীমান্তবাসী :

নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর বসবাসকারী মানুষের জীবন শান্তি ও সংঘাতের মাঝে আটকে আছে। সাম্প্রতিক পহেলগাম হামলার পর সৃষ্ট উত্তেজনা ভারত ও পাকিস্তানকে আরও একবার সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। গোলাবর্ষণের ফলে বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং বহু মানুষের জীবনহানি ঘটেছে।
কানাডার পাকিস্তানি লেখিকা আনাম জাকারিয়ার মতে, নিয়ন্ত্রণরেখায় থাকা পরিবারগুলো ভারত ও পাকিস্তানের খেয়ালখুশি এবং (দুই দেশের মধ্যে) উত্তেজনার শিকার হচ্ছে। প্রতিটি সংঘর্ষে তাদের জীবিকা, অবকাঠামো এবং দৈনন্দিন জীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
‘যুদ্ধকালীন সীমানা’র বাস্তবতা :
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিবাদ এই LoC-কে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক সংঘাতপূর্ণ সীমান্তগুলির একটিতে পরিণত করেছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ হ্যাপিমন জেকবের মতে, এখানে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন লো লেভেল ফায়ারিং থেকে শুরু করে বড় পর্যায়ের ভূমি দখল বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পর্যন্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা এই সীমান্তকে সংঘাতের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং রক্ত দিয়ে টানা সীমান্তের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখেন। আনাম জাকারিয়া ব্যাখ্যা করেন, এটা এমন একটা রেখা যা কাশ্মীরিদের কথা বিবেচনা না করে ভারত ও পাকিস্তান টেনেছে এবং যেখানে সামরিকীকরণ ও অস্ত্রশস্ত্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের কারণ ও প্রভাব :

২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির আগে ভারত সীমান্তে ব্যাপক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল। যদিও ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত ছিল, ২০০৮ সাল থেকে আবার উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘাত দেখা যায়। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়, যা স্বল্প সময়ের জন্য শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল।
কার্নেগি ইন্ডিয়ার সূর্য ভালিয়াপ্পান কৃষ্ণা বলেন, নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর আগে চার বছর সীমান্তে তুলনামূলক শান্তি দেখা গিয়েছিল। তীব্র গোলাগুলির সময় হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের জীবনে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
হ্যাপিমন জেকব যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন: প্রথমত, ভারত শাসিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের সুবিধার জন্য পাকিস্তান প্রায়শই কভার ফায়ার ব্যবহার করে; দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ করে, ‘ভারত বিনা প্ররোচনায় বেসামরিক এলাকায় গুলি চালাচ্ছে।’
তার মতে, এই অস্থিরতা প্রায়শই স্থানীয় সামরিক গতিশীলতার ফলাফল এবং ফিল্ড কমান্ডারদের উদ্যোগেই ঘটে, কখনও কেন্দ্রীয় অনুমোদন নিয়ে, আবার কখনও কেন্দ্রীয় অনুমোদন ছাড়াই।
ভবিষ্যতের ভাবনা: অনিশ্চিত সমাধান :
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ LoC-কে একটি আনুষ্ঠানিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তে পরিণত করার ধারণা পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন। তবে অধ্যাপক সুমন্ত্র বসু এই সম্ভাবনাকে অসম্ভব বলে মনে করেন, কারণ এর অর্থ হবে কাশ্মীরের উপর ভারতের দাবি মেনে নেওয়া, যা পাকিস্তানের পক্ষে হলি গ্রেইলের সমতুল্য (যা লাভ করা অত্যন্ত কঠিন)। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে LoC-কে ‘সফ্ট বর্ডারে’ রূপান্তরিত করার বিষয়টি ভারত-পাকিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে ছিল, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আবার উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, যা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য ‘সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তার চক্রকে’ ফিরিয়ে এনেছে।
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের এক হোটেল কর্মচারী বিবিসি উর্দুকে বলেছিলেন, এরপর কী হবে তা আপনি জানেন না। নিয়ন্ত্রণ রেখার দিকে মুখ করে আজ রাতে কেউই ঘুমাতে চায় না। এই কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দেয়, শান্তি কতটা ভঙ্গুর হতে পারে যখন জানালার মুখ যুদ্ধের দিকে খোলা থাকে।