ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সর্বশেষ বড় সামরিক সংঘাত হয়েছিল ২০১৯ সালে, কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার পর। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর মতে, সে সময় পারমাণবিক উত্তেজনার আশঙ্কায় মার্কিন কর্মকর্তারা রাতের ঘুম হারিয়েছিলেন। সেই উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত সাময়িকভাবে প্রশমিত হলেও, ছ’বছর পর আবারও দুই প্রতিবেশী পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে—এইবার আরও জটিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।

আমেরিকার অবস্থান: ‘এই যুদ্ধটা আমাদের মাথাব্যথা নয়’
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্সের বক্তব্য স্পষ্ট—এই যুদ্ধ আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপের বিষয় নয়। ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, আমেরিকা উত্তেজনা প্রশমিত দেখতে চাইলেও, তারা কোনও পক্ষকে চাপ দিয়ে অস্ত্র নামাতে বলবে না।
পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও অবশ্য কূটনৈতিক পথে দুই দেশকে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। তবে আমেরিকার বর্তমান অবস্থান মূলত ট্রাম্প-যুগের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন। ট্রাম্প প্রশাসনের মতোই তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকতে চায় না, কিন্তু দূর থেকে কথাবার্তার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রস্তুত।
চীনের দৃষ্টিভঙ্গি: ‘সামরিক প্রযুক্তির পরীক্ষাগার’ পাকিস্তান?
পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী চীন এবার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। ভারতের সাম্প্রতিক ‘অপারেশন সিন্দুরে’র পর চীন উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং দুই পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়। তবে চীনা সংবাদ মাধ্যম ও বিশ্লেষকদের মতে, চীন মূলত তাদের নিজস্ব সামরিক প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিরীক্ষণেই আগ্রহী।
চীনের তৈরি জে-১০সি ফাইটার জেট যদি ভারতের রাফাল জেটের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে তা চীনা সামরিক রফতানির জন্য বড় বিজ্ঞাপন হতে পারে। ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার দর হু হু করে বেড়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান যেন হয়ে উঠেছে চীনের জন্য একটি কার্যকর ‘টেস্ট এনভায়রনমেন্ট’।
রাশিয়ার ভূমিকা: ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন
রাশিয়া একদিকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সংযমের পরামর্শ দিলেও, তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সেই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পুতিন-মোদি ফোনালাপ, ইগলা-এস মিসাইল সিস্টেম সরবরাহ, এবং দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক—সবকিছু মিলিয়ে রাশিয়া যে ভারতের দিকেই একটু বেশি ঝুঁকে আছে তা স্পষ্ট।
বিশ্লেষক চিতিজ বাজপাই মনে করেন, রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক শীতল যুদ্ধকাল থেকে ঘনিষ্ঠ এবং সাম্প্রতিক রুশ-ভারত বাণিজ্য সেই সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। ফলে রাশিয়া সংঘাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলেও, বাস্তবে তারা ভারতেরই ‘প্রায়োরিটি পার্টনার’ হিসেবে থেকে যাবে।

সংঘাতের ছায়ায় ভূরাজনীতির পালাবদল :
দক্ষিণ এশিয়ার এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া—তিন পরাশক্তির ভিন্ন কূটনৈতিক কৌশল ও আগ্রহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। কেউ যুদ্ধ এড়িয়ে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত, কেউবা সংঘাতকে সামরিক প্রযুক্তির পরীক্ষার সুযোগ হিসেবে দেখছে, আবার কেউ ঐতিহাসিক মিত্রতার কারণে একপক্ষের দিকে ঝুঁকে আছে। এই ত্রিমুখী কূটনৈতিক নীতির মাঝে ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষ কেবল দুই দেশের নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।