যোগব্যায়াম (Yoga) মানব জীবনে সুস্থতা, মানসিক স্থিতি এবং আত্মিক উন্নয়নের এক মহৎ পথ। যোগাসনের মধ্যে কিছু আসন আছে যেগুলি শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতিই ঘটায় না, বরং মানসিক শক্তি, ধৈর্য্য এবং আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি করে।এই ধরনের একটি চ্যালেঞ্জিং এবং অত্যন্ত কার্যকর আসন হলো “পিঞ্চা ময়ূরাসন” (Pincha Mayurasana)। একে “ফোরআর্ম স্ট্যান্ড” বা “পেখম ময়ূর আসন” নামেও ডাকা হয়।
‘পিঞ্চা’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ হলো ‘পেখম’ বা ‘পাখা’ এবং ‘ময়ূর’ অর্থাৎ ‘ময়ূর পাখি’। ‘আসন’ মানে বসা বা শারীরিক ভঙ্গি। এই আসনে শরীরের ভঙ্গিমা ঠিক যেন এক ময়ূর তার পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে, সেই রূপ ধারণ করে।পিঞ্চা ময়ূরাসনের মাধ্যমে শরীরের ভার সামনের বাহু এবং কনুইয়ের উপর রাখা হয়, যা একটি উল্টোনো ভঙ্গি তৈরি করে। এটি শক্তি, স্থিতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের এক অপূর্ব উদাহরণ।এটি Inversion আসনের অন্যতম রূপ।
Inversion কী?
ইনভার্সন (Inversion) আসন হল যোগের এমন একটি ভঙ্গি যেখানে শরীরকে উল্টো করে মাথাকে হৃদপিণ্ড বা নিতম্বের নিচে রাখা হয়, যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উল্টে দেয়। এই আসনগুলি রক্ত প্রবাহ বাড়াতে, মনোযোগ এবং সতর্কতা বৃদ্ধি করতে এবং শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে পারে।

পিঞ্চা ময়ূরাসনের ইতিহাস ও উৎস, History and origins of Pincha Mayurasana
পিঞ্চা ময়ূরাসনের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, এটি প্রাচীন যোগশাস্ত্রে সরাসরি উল্লেখিত না হলেও আধুনিক যুগে যোগব্যায়ামের বিকাশের সাথে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।২০শ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগগুরু শ্রী তিরুমলাই কৃষ্ণমাচার্য এবং তাঁর ছাত্র বি. কে. এস. আয়েঙ্গার, পতভি জয়িস প্রমুখের মাধ্যমে এই ধরনের অনেক উন্নত আসন বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।
বিশেষ করে আয়েঙ্গার যোগ (Iyengar Yoga)-তে পিঞ্চা ময়ূরাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচিত। আয়েঙ্গার যোগব্যায়ামে শরীরের ভারসাম্য, অঙ্গসংস্থান এবং শক্তির উপর জোর দেওয়া হয়, যা এই আসনের মূল বৈশিষ্ট্য।যদিও এই আসনটি প্রাচীন গ্রন্থ যেমন “হঠযোগ প্রদীপিকা” বা “ঘেরণ্ড সংহিতা”-তে সরাসরি বর্ণিত নয়, এটি আধুনিক যুগের ‘আসনা সংস্কৃতি’ বা Modern Postural Yoga-র অংশ। এই সংস্করণে শরীরের ভারসাম্য, ফোকাস এবং মনোসংযোগ বৃদ্ধিতে পিঞ্চা ময়ূরাসনের গুরুত্ব অপরিসীম।

পিঞ্চা ময়ূরাসনের পদ্ধতি, The method of Pincha Mayurasana
নীচে পিঞ্চা ময়ূরাসনের পদ্ধতি দেওয়া হল:-
- প্রথমে মাটিতে একটি যোগম্যাট বিছিয়ে নিয়ে “ডলফিন পোজ” বা “অর্ধ পিঞ্চা” দিয়ে ওয়ার্ম আপ করতে হবে।
- তারপর নিতম্ব উঁচু করে কনুই মাটিতে রেখে হাতের তালু মাটিতে দৃঢ়ভাবে রাখতে হবে।
- এরপর কাঁধ, কনুই এবং হাতকে এক রেখায় রাখতে হবে।
- তারপর আপনার শরীরের ওজন ধীরে ধীরে কনুই এবং হাতের উপর নিয়ে আসতে হবে।
- এরপর একটি পা ভাঁজ করে উপরের দিকে তুলতে হবে আর অন্য পাকে তুলে শরীর সোজা করতে হবে। (স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বজায় রাখতে হবে)
- এর শরীর সোজা রেখে, হাঁটার মতো ভঙ্গি করে উল্টো হয়ে দাঁড়াতে হবে।
Also check out: সেতু বন্ধাসনের ইতিহাস ও উৎস
পিঞ্চা ময়ূরাসনের ছবি, Pincha Mayurasana Picture
নীচে পিঞ্চা ময়ূরাসনের কয়েকটি ছবি দেওয়া হল:-

পিঞ্চা ময়ূরাসনের শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা, Physical and mental benefits of Pincha Mayurasana
পিঞ্চা ময়ূরাসন শুধু শরীরকেই সুস্থ রাখে না এটি মনকেও ভালো রাখে।
পিঞ্চা ময়ূরাসনের কয়েকটি শারীরিক উপকারিতা নীচে দেওয়া হল:-
- শরীরের উপরের অংশের শক্তি বৃদ্ধি: এই আসনটি বাহু, কাঁধ এবং কোর পেশীগুলির শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে, যা পুরো শরীরের ওজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক।
- নমনীয়তা বৃদ্ধি: এটি ঘাড়, কাঁধ এবং পেটের অঞ্চলে ভালো প্রসার ঘটায়, যা শরীরের নমনীয়তা বাড়ায়।
- ভারসাম্য ও একাগ্রতা: ফরআর্ম স্ট্যান্ড হওয়ার কারণে শরীরের ওজন বাহুর উপর ভারসাম্য রাখা প্রয়োজন, যা একাগ্রতা এবং ভারসাম্য উন্নত করে।
- পেটের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শক্তিশালী করা: এই আসনটি পেটে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে লিভার, প্লীহা, অগ্ন্যাশয় এবং কিডনির মতো অঙ্গগুলোকে শক্তি জোগায়।
- হজমে সহায়তা: এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে, ক্ষুধা বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- শারীরিক সহনশীলতা: এই কঠিন ভঙ্গিটি অনুশীলন করার সময় শারীরিক সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
পিঞ্চা ময়ূরাসনের কয়েকটি মানসিক উপকারিতা নীচে দেওয়া হল:-
- মানসিক স্বচ্ছতা: শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষা করার এই প্রক্রিয়া মানসিক স্বচ্ছতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- মানসিক চাপ কমানো:এই আসনটি মস্তিষ্ককে শান্ত করে, যার ফলে মানসিক চাপ এবং হালকা বিষণ্ণতা দূর হয়।
- একাগ্রতা ও ফোকাস বৃদ্ধি: ভারসাম্যপূর্ণ এই ভঙ্গিটি মনকে শান্ত রাখতে এবং একাগ্রতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: একটি কঠিন ভঙ্গি সম্পন্ন করার মাধ্যমে অনুশীলনকারী আত্ম-আবিষ্কারের পথে এগিয়ে যায় এবং নিজের উপর বিশ্বাস অর্জন করে।
- মানসিক দৃঢ়তা অর্জন: এই চ্যালেঞ্জিং আসনটি শারীরিক সহনশীলতা বাড়ানোর সাথে সাথে মানসিক দৃঢ়তাও তৈরি করে।
- ভয়ের মোকাবিলা: ভারসাম্যপূর্ণ বিপরীত ভঙ্গি হিসাবে, পিঞ্চা ময়ূরাসন পতনের ভয় কাটিয়ে উঠতে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের শারীরিক সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে সাহায্য করে।
পিঞ্চা ময়ূরাসন কতবার করা উচিত? How often should Pincha Mayurasana be done?
পিঞ্চা ময়ূরাসন কতবার করা উচিত তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, তবে এটি একটি উন্নত ভঙ্গি এবং এটি আপনার শারীরিক শক্তি, ভারসাম্য এবং ধৈর্য্যের উপর নির্ভর করে। একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে ধীরে ধীরে ভঙ্গিটি চেষ্টা করা উচিত এবং আপনার শরীরের শক্তি বাড়ানোর সাথে সাথে ভঙ্গিতে থাকার সময়কাল বাড়ানো যেতে পারে।

পিঞ্চা ময়ূরাসনের সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা, Warnings and prohibitions of Pincha Mayurasana
পিঞ্চা ময়ূরাসনের কয়েকটি সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা নীচে দেওয়া হল:-
- যাদের হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ঘাড়, কাঁধ, বা পিঠের আঘাত, এবং মাথাব্যথা, গ্লুকোমা, হৃদরোগ ইত্যাদির মতো সমস্যা আছে তাদের এই আসনটি করা উচিত নয়।
- গর্ভবতী মহিলাদের এই আসন থেকে বিরত থাকতে হবে।
- মাসিকের সময় এই আসন করা উচিত নয়।
- এছাড়াও যদি কারোর কোনো শারীরিক অসুস্থতা থাকে তবে তার একজন যোগ প্রশিক্ষক বা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আসনটি করা উচিত।
- মাথা ঘোরা, ভয় বা ভেস্টিবুলার সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের এই আসন না করাই ভালো। তবুও যদি আপনি এই আসনটি করতে চান তাহলে দেওয়ালের সাহায্য নিতে পারেন।
- এই আসনটি করার সময় অতিরিক্ত চাপ নেওয়া যাবেনা।
পরিশেষে
পিঞ্চা ময়ূরাসন শুধুমাত্র একটি যোগাসন নয়, এটি একটি মানসিক ও শারীরিক শৃঙ্খলার চূড়ান্ত রূপ। এই আসনের মাধ্যমে শরীরের ভারসাম্য, মনোসংযোগ, আত্মবিশ্বাস এবং শারীরিক শক্তি একযোগে গড়ে ওঠে।তবে এটি একটি উন্নত স্তরের আসন হওয়ায় ধৈর্য্য, নিয়মিত অনুশীলন এবং সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে অভ্যাস করা উচিত। যোগাসনের পথ ধরেই আমরা সুস্থ, শান্ত ও সজীব জীবনযাপন করতে পারি আর পিঞ্চা ময়ূরাসন সেই যাত্রার একটি অনবদ্য ধাপ।
পিঞ্চা ময়ূরাসন হল আত্ম-আবিষ্কার, স্থিতিস্থাপকতা এবং আত্মবিশ্বাসের একটি পথ, যা কেবল একটি অবস্থানের চেয়েও বেশি কিছু।নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এটি আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে।আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিয়মিত যোগাভ্যাসের মাধ্যমে জীবনের মান উন্নত করা, এবং পিঞ্চা ময়ূরাসনের মতো শক্তিশালী আসনগুলো শেখার জন্য ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া।আশা করছি আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের পছন্দ হবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে এই পোস্টটি আপনি আপনাদের বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও চেনা পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারেন।