সবলা প্রকল্প: পশ্চিমবঙ্গের কিশোরীদের স্বনির্ভরতার পথে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ | Sabla Project Details in Bengali

পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (ডাব্লুবিবিএসই): ইতিহাস, ভূমিকা এবং কার্যক্রম | West Bengal Board of Secondary Education (WBBSE): History, Role and Activities in Bangla পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (ডাব্লুবিবিএসই) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য দায়ী প্রাথমিক শিক্ষামূলক কর্তৃপক্ষ। রাজ্য সরকারের অধীনে ডাব্লুবিবিএসই স্বায়ত্তশাসিত পরীক্ষামূলক সংস্থা হিসাবে কাজ করে মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনা করে, সিলেবাস ডিজাইন করে, পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত করে এবং রাজ্যের হাজার হাজার স্কুল জুড়ে সামগ্রিক শিক্ষার মান নিশ্চিত করে। বছরের পর বছর ধরে, এটি ভারতের বৃহত্তম এবং প্রভাবশালী স্কুল শিক্ষা বোর্ডগুলির মধ্যে একটি হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে, কেবল শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নয়, লক্ষ লক্ষ লোকের একাডেমিক যাত্রাকে গঠনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডাব্লুবিবিএসই এর ইতিহাস ও স্থাপনাকাল : ডাব্লুবিবিএসইর ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে স্বাধীন ভারতের প্রথম বছরগুলিতে ফিরে যেতে হয়। ১৯৫০ সালের পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা আইন ১৯৫১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বোর্ড তৈরির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। সেই সময়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিরাম নিয়েছিল। প্রক্রিয়াটি বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রচলিত করতে, সদ্য গঠিত বোর্ড ক্লাস x এর পরীক্ষা পরিচালনার কাজটি গ্রহণ করেছিল। বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন শ্রী অপারাবা কুমার চন্দা এবং এর উদ্বোধনী বছরে ডাব্লুবিবিএসই প্রায় ১,২৭০ টি উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা করেছিলেন, যার মধ্যে অনেকগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, অনুমোদিত স্কুলগুলির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, ১৯৬৩ সালের মধ্যে স্কুলের সংখ্যা ২,৩১২ তে পৌঁছেছিল। ১৯৬৪ সালে, বোর্ডের নামকরণ করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড হিসাবে। ১৯৬৩ সালের পশ্চিমবঙ্গ বোর্ড অফ মাধ্যমিক শিক্ষা আইনের বিধানের অধীনে, ডাঃ জে সি সেনগুপ্তকে চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এর বৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণ : প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডাব্লুবিবিএসই এর এখতিয়ারটি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছে। ১৯৫০ এর দশকে মাত্র কয়েক হাজার শিক্ষার্থী পরিচালনা করা থেকে, বোর্ড আজ বার্ষিক ১০ লক্ষেরও বেশি প্রার্থীর জন্য পরীক্ষা পরিচালনা করে। ১৯৫২ সালে প্রথম মধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায় ৪২,০০০ শিক্ষার্থী ছিল, তবে ২০১৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটি বেড়েছে ১০.৬৬ লক্ষ পরীক্ষার্থীতে। বর্তমানে এই বোর্ড পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১১,০০০ জুনিয়র উচ্চ এবং উচ্চ বিদ্যালয় তদারকি করে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারী-স্পনসর প্রাপ্ত স্কুল, বেসরকারী সহায়তা প্রাপ্ত স্কুল, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল, ডিএ স্কুল প্রাপ্তি এবং বেসরকারী বিনা সহায়তায় পরিচালিত সংস্থাগুলি। ডাব্লুবিবিএসই সরকারী বিদ্যালয়ের জন্য একাডেমিক কর্তৃপক্ষ হিসাবে কাজ করে এবং অনুমোদিত সংস্থাগুলিতে সামগ্রিক শিক্ষাগত মানগুলিও পর্যবেক্ষণ করে। ডাব্লুবিবিএসই এর কাঠামো এবং সদর দফতর : ডাব্লুবিবিএসই তার সদর দফতর কর্তৃপক্ষ কলকাতার সল্টলেক থেকে এবং কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ডিরোজিও ভবন থেকে কাজ করে। বর্তমানে বোর্ডের সভাপতিত্ব করেছেন ডাঃ রামানুজ গাঙ্গুলি, পাশাপাশি শ্রী সুব্রত ঘোষ সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (https://wbbse.wb.gov.in/) শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য বিজ্ঞপ্তি, ফলাফল, পরীক্ষার সময়সূচী এবং একাডেমিক আপডেটের প্রাথমিক উৎস হিসাবে কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এর ভূমিকা এবং কার্যক্রম : পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বা ডাব্লুবিবিএসইর কাজ শুধু পরীক্ষা পরিচালনা নয়, বরং এর বাইরেও বেশ কিছু কাজ আছে। পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষার গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর প্রধান কাজগুলির মধ্যে রয়েছে: 1। পরীক্ষা পরিচালনা: মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনা হল ডাব্লুবিবিএসইর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মার্চ/এপ্রিলে প্রতিবছর পরিচালিত, এই পরীক্ষাটি একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক যাত্রায় একটি মাইলফলক চিহ্নিত করে এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য যোগ্যতা নির্ধারণ করে। 2। পাঠ্যক্রম এবং সিলেবাস সেট করা: ডাব্লুবিবিএসই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য রেখে মাধ্যমিক পাঠ্যক্রম এবং সিলেবাস ডিজাইন করে। বোর্ড পরিবর্তিত চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সময়ে সময়ে সিলেবাসটি সংশোধন করে। সর্বশেষ প্রধান সংশোধনটি ২০২৩ সালে হয়েছিল এবং আগামীতে আরও পরিবর্তনগুলি নিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। 3। পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ: বোর্ড ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে এবং নবম এবং দশম শ্রেনীর কিছু বিষয়ের জন্যও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে। অন্যদিকে, এটি বেসরকারী প্রকাশকদের দ্বারা প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলি অনুমোদন করে, যেমন সাঁওতালি, নেপালি এবং উর্দুর মতো আঞ্চলিক ও সংখ্যালঘু ভাষায় বোর্ডের অনুমোদিত কিছু বই রয়েছে। 4। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা: শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার গুণমান বাড়ানোর জন্য, ডাব্লুবিবিএসই শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ সেশন, ওয়ার্কশপ এবং ইন-সার্ভিস প্রোগ্রামের আয়োজন করে। বোর্ড এটি নিশ্চিত করে যে শিক্ষাবিদরা লক্ষ্যযুক্ত শিক্ষার ফলাফলগুলি অর্জনের জন্য সজ্জিত। 5। আরটিই নির্দেশিকা বাস্তবায়ন: ডান টু এডুকেশন অ্যাক্ট, ২০০৯, এবং নিখরচায় এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিধি, ২০১২ এর পশ্চিমবঙ্গের অধিকারের সাথে একত্রিত হয়ে বোর্ড যথাযথ শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা, একাডেমিক সময়সূচির সাথে আনুগত্য এবং সমস্ত শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম শিক্ষার ফলাফল নিশ্চিত করে। 6। মহিলাদের শিক্ষার প্রচার: ডাব্লুবিবিএসই শিক্ষায় মহিলা অংশগ্রহণ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০২০ সালের মধ্যমিক পরীক্ষায়, মেয়ে শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তি ছেলের তুলনায় ৫৬.৭০% -তে দাঁড়িয়েছিল, যা শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি ইতিবাচক প্রবণতা প্রতিফলিত করে। 7। নতুন বিষয় প্রবর্তন: আধুনিক বিশ্বের চাহিদা মেটাতে, বোর্ড মাধ্যমিক স্তরে তথ্য প্রযুক্তি, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন এবং হার্ডওয়্যার পরিচালনার মতো নতুন বিষয় চালু করেছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার গুরুত্ব : ডাব্লুবিবিএসই দ্বারা পরিচালিত মাধ্যমিক পরীক্ষা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম পাবলিক পরীক্ষা। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থীদের জন্য, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক কারণ ফলাফলগুলি উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষায় তাদের স্ট্রিম - বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা আর্টস - এর পছন্দকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এই পরীক্ষায় পারফরম্যান্স একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক এবং ক্যারিয়ারের ট্র্যাজেক্টোরি নির্ধারণে একটি সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা পালন করে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি কঠোর, এবং সহজে অ্যাক্সেসের জন্য ফলাফলগুলি অনলাইনে প্রকাশিত হয়। মার্কশিটগুলির পাশাপাশি বোর্ড সফল প্রার্থীদের স্কুল-লিভিং শংসাপত্র জারি করে। শিক্ষামূলক উন্নয়নে ডাব্লুবিবিএসই এর অবদান : সময়ের সাথে সাথে উন্নয়নের মাধ্যমে ডাব্লুবিবিএসই নিজেকে নিছক পরীক্ষার সংস্থা থেকে শিক্ষাগত উন্নয়নের মূল খেলোয়াড় হিসাবে রূপান্তরিত করেছে। এটি বহির্মুখী ক্রিয়াকলাপ, নৈতিক শিক্ষা এবং সহ-পাঠ্যক্রমিক ব্যবস্থার প্রচার করে সামগ্রিক বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সিলেবাস পুনর্গঠন করে, আধুনিক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে এবং প্রযুক্তি-চালিত বিষয়গুলিকে সংহত করে। পাশাপাশি বোর্ড নিশ্চিত করে যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিক্ষার্থীরা জাতীয় এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ উভয়ের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তদুপরি, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং অ্যাক্সেসযোগ্য শিক্ষার উপর এর জোর সর্বস্ত শিক্ষা অভিযানের (সকলের জন্য শিক্ষা) দিকে দৃষ্টি প্রতিফলিত করে। বার্ষিক ১০ লক্ষেরও বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষার জন্য উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে রাজ্যে মানবসম্পদ বিকাশে বোর্ডের অবদান স্মৃতিসৌধ। উপসংহার পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (ডাব্লুবিবিএসই) পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষার ভিত্তি হিসাবে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি হাজার হাজার স্কুল এবং কয়েক মিলিয়ন শিক্ষার্থী পরিচালনা করে, এটি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন কার্যকলাপ সহ আরটিই নির্দেশাবলী বাস্তবায়নের মাধ্যমে বোর্ড কেবল একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বই নয়, শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিকেও নিশ্চিত করেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে, ডাব্লুবিবিএসই নতুন বিষয় প্রবর্তন করে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়নের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তিত প্রয়োজনের সাথে খাপ খাইয়ে চলেছে। তরুণ মনকে গঠনে এবং তাদের উচ্চশিক্ষা এবং ক্যারিয়ারের দিকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অমূল্য রয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ডাব্লুবিবিএসই নিঃসন্দেহে রাজ্যের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও উচ্চতার দিকে চালিত করে, নিঃসন্দেহে সর্বাগ্রে থাকবে।

ভারতের উন্নয়ন আজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও দেশের একটি বড় অংশে আজও কন্যাশিশুরা পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আর্থিক স্বনির্ভরতার অভাবে অনেক সময়েই তারা সমাজের মূল স্রোতে যোগ দিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ২০১১ সালে চালু করেছিল ‘সবলা প্রকল্প’। মূলত ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরীদের জন্য তৈরি এই প্রকল্পটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মাধ্যমে চালু করা হয়।

এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল— কিশোরীদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে তোলা। এর ফলে তারা শুধু পরিবারের নয়, বরং সমগ্র সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সবলা প্রকল্পের সূচনা, Launch of the Sabala project :

সবলা প্রকল্পটি ভারত সরকার কর্তৃক কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নের জন্য চালু করা ‘রাজীব গান্ধী প্রকল্প’ (RGSEAG)-এর একটি অংশ। ২০১০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পরীক্ষামূলকভাবে Rajiv Gandhi Scheme for Empowerment of Adolescent Girls চালু করে। প্রথমে এটি দেশের ২০০টি জেলায় শুরু হয়েছিল। পরে পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যে এই প্রকল্প চালু হয় কিশোরী মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বনির্ভরতা বাড়ানোর জন্য।

পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পকেই বলা হয় সবলা প্রকল্প (Sabala Scheme)।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে ‘সবলা প্রকল্প’ চালু হয়। শুরুতে এটি পাইলট ভিত্তিতে ৭টি জেলায় কার্যকর করা হয়—

  • কলকাতা
  • কোচবিহার
  • নদিয়া
  • জলপাইগুড়ি
  • পুরুলিয়া
  • মালদা
  • আলিপুরদুয়ার

এই সাতটি জেলার প্রায় ১২.৭২ লক্ষ কিশোরী প্রকল্পের সুবিধা পেতে শুরু করে। পরবর্তীতে প্রকল্পের আওতা বাড়ানো হয়। শুরু থেকেই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে (Anganwadi Centers) কেন্দ্রবিন্দু করে এই কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।

সবলা প্রকল্পের উদ্দেশ্য, Objectives of the Sabla Project :

সবলা প্রকল্পের সূচনা
Pin it

সবলা প্রকল্পের মূল লক্ষ্য শুধুমাত্র পুষ্টি সরবরাহ নয়, বরং কিশোরীদের সার্বিক উন্নয়ন। এই উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল—

  1. পুষ্টি উন্নয়ন – কিশোরীদের জন্য বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা।
  2. স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি – শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, কৈশোরকালীন সমস্যার মোকাবিলা শেখানো।
  3. বৃত্তিমূলক দক্ষতা বৃদ্ধি – সেলাই, হস্তশিল্প, বিউটিশিয়ান, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ।
  4. জীবন দক্ষতা শিক্ষা – আত্মবিশ্বাস তৈরি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধান ও নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন।
  5. বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা – যারা পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে তাদের আবার শিক্ষায় যুক্ত করা।
  6. নারী ক্ষমতায়ন – মেয়েদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করে তোলা।

সবলা প্রকল্পের যোগ্যতা, Eligibility for Sabala Prakalpa :

সবলা প্রকল্পের সুবিধা নিতে হলে আবেদনকারীর কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলি হলো—

  • বয়স ১১ থেকে ১৮ বছর হতে হবে।
  • কিশোরীকে অবশ্যই অবিবাহিতা হতে হবে।
  • সে কোনও বিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রী হতে হবে (বিদ্যালয় বহির্ভূতদের ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা রয়েছে)।
  • শুধুমাত্র সাতটি জেলার (কলকাতা, কোচবিহার, নদিয়া, জলপাইগুড়ি, পুরুলিয়া, মালদা, আলিপুরদুয়ার) মেয়েরা এই প্রকল্পের আওতায় আসবে।

সবলা প্রকল্পে আবেদনের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস, Documents required for applying for the Sabala project :

সবলা প্রকল্পে আবেদন করার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলি হল:

  1. পরিচয়পত্র – আধার কার্ড / ভোটার কার্ড / প্যান কার্ড
  2. জন্ম সনদ (Birth Certificate)
  3. স্কুলের আইডি কার্ড (যদি স্কুলে পড়াশোনা করে)
  4. আবাসিক প্রমাণপত্র – রেশন কার্ড অথবা বাসস্থান সনদ
  5. পাসপোর্ট সাইজ ছবি

সবলা প্রকল্পের সুবিধা, Benefits of Sabala Prakalpa :

  • পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ : ১১ থেকে ১৮ বছরের কিশোরীরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাবার পায়।
  • স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা : মেয়েদের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু সুরক্ষা বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান দেওয়া হয়।
  • বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ : বিউটিশিয়ান কোর্স, হস্তশিল্প, সেলাই, ডাইং, প্রিন্টিং, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
  • কিশোরী কার্ড প্রদানা : প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী কিশোরীকে একটি ‘কিশোরী কার্ড’ দেওয়া হয়, যাতে তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য থাকে।
  • শিক্ষা ও জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি : বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয় এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় দক্ষতা শেখানো হয়।
  • কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় : কন্যাশ্রী প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত বহু কিশোরীও সবলা প্রকল্পের মাধ্যমে পরিপূরক পুষ্টি পেয়ে থাকে।

সবলা প্রকল্পের কর্মপদ্ধতি, Sabla Project Procedure :

  • প্রকল্পের কাজ প্রধানত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং ব্লকের সিডিপিও (Child Development Project Officer)-র মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
  • প্রতিটি কিশোরীকে নির্দিষ্ট অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করা হয়।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্য সরবরাহ করা হয়।
  • প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে বৃত্তিমূলক কোর্স করানো হয়।
  • শিক্ষার বাইরে থাকা কিশোরীদের আবার পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
  • প্রকল্প বাস্তবায়নে ICDS (Integrated Child Development Services) এবং স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সবলা প্রকল্পের সাফল্য ও প্রভাব,
Pin it

সবলা প্রকল্পের সাফল্য ও প্রভাব, The success and impact of the Sabala project :

সবলা প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বহু কিশোরী বাস্তব সুবিধা পেয়েছে।

  • প্রায় ১২.৭২ লক্ষ কিশোরী প্রকল্পের আওতায় এসেছে।
  • বিদ্যালয় ছুটের হার ২০১০-১১ সালে ২.৮ লক্ষ থেকে কমে ২০১৬-১৭ সালে ৯২,০০০ হয়েছে।
  • প্রায় ৪১ হাজার বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোরী বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
  • প্রায় ১৬০০ কিশোরী পুনরায় স্কুল বা অপ্রথাগত শিক্ষায় ভর্তি হয়েছে।
  • কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ৯৮,৮২০ কিশোরী সবলা প্রকল্প থেকে পরিপূরক পুষ্টি পেয়েছে।

এছাড়া গ্রামীণ বাংলায় কিশোরীদের মধ্যে স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা, আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরতার ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে।

সবলা প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা, Challenges and limitations of the Sabala project :

যদিও সবলা প্রকল্পের প্রভাব ইতিবাচক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—

  • অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামোগত সমস্যা।
  • গ্রামীণ সমাজে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রথা এখনও পুরোপুরি কমেনি।
  • বিদ্যালয় বহির্ভূত মেয়েদের পুনরায় পড়াশোনায় যুক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।
  • অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পের সুবিধা সব জেলায় এখনও প্রসারিত হয়নি।

সবলা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, Future prospects of the Sabala project :

সবলা প্রকল্প ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ ও শহুরে কিশোরীদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে। আগামী দিনে—

আরও বেশি জেলায় এই প্রকল্প চালু করা হলে কন্যাশিশুদের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার শিক্ষা, অনলাইন দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ যোগ করলে আধুনিক যুগে মেয়েরা আরও স্বনির্ভর হবে।
কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি অন্যান্য নারী-কেন্দ্রিক প্রকল্পের সঙ্গে একত্রে কাজ করলে এর প্রভাব আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

উপসংহার

এক কথায়, সবলা প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের কিশোরীদের জন্য এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। এই প্রকল্প কেবলমাত্র পুষ্টি নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৃত্তিমূলক দক্ষতা এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে কিশোরীদের সুস্থ, সবল ও স্বনির্ভর করে তুলছে।

ভারতের মতো দেশে যেখানে কন্যাশিশু এখনও বহু ক্ষেত্রে অবহেলিত, সেখানে সবলা প্রকল্প মেয়েদের সম্মান ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের বিস্তার হলে সমাজের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর হবে এবং কন্যাশিশুরা আত্মনির্ভর হয়ে দেশের উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।


RIma Sinha

Rima Sinha is a professional journalist and writer with a strong academic background in media and communication. She holds a Bachelor of Arts from Tripura University and a Master’s degree in Journalism and Mass Communication from Chandigarh University. With experience in reporting, feature writing, and digital content creation, Rima focuses on delivering accurate and engaging news stories to Bengali readers. Her commitment to ethical journalism and storytelling makes her a trusted voice in the field.

Recent Posts