ভারতের উন্নয়ন আজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও দেশের একটি বড় অংশে আজও কন্যাশিশুরা পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আর্থিক স্বনির্ভরতার অভাবে অনেক সময়েই তারা সমাজের মূল স্রোতে যোগ দিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ২০১১ সালে চালু করেছিল ‘সবলা প্রকল্প’। মূলত ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরীদের জন্য তৈরি এই প্রকল্পটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মাধ্যমে চালু করা হয়।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল— কিশোরীদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে তোলা। এর ফলে তারা শুধু পরিবারের নয়, বরং সমগ্র সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সবলা প্রকল্পের সূচনা, Launch of the Sabala project :
সবলা প্রকল্পটি ভারত সরকার কর্তৃক কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নের জন্য চালু করা ‘রাজীব গান্ধী প্রকল্প’ (RGSEAG)-এর একটি অংশ। ২০১০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পরীক্ষামূলকভাবে Rajiv Gandhi Scheme for Empowerment of Adolescent Girls চালু করে। প্রথমে এটি দেশের ২০০টি জেলায় শুরু হয়েছিল। পরে পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যে এই প্রকল্প চালু হয় কিশোরী মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বনির্ভরতা বাড়ানোর জন্য।
পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পকেই বলা হয় সবলা প্রকল্প (Sabala Scheme)।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে ‘সবলা প্রকল্প’ চালু হয়। শুরুতে এটি পাইলট ভিত্তিতে ৭টি জেলায় কার্যকর করা হয়—
- কলকাতা
- কোচবিহার
- নদিয়া
- জলপাইগুড়ি
- পুরুলিয়া
- মালদা
- আলিপুরদুয়ার
এই সাতটি জেলার প্রায় ১২.৭২ লক্ষ কিশোরী প্রকল্পের সুবিধা পেতে শুরু করে। পরবর্তীতে প্রকল্পের আওতা বাড়ানো হয়। শুরু থেকেই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে (Anganwadi Centers) কেন্দ্রবিন্দু করে এই কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
সবলা প্রকল্পের উদ্দেশ্য, Objectives of the Sabla Project :
সবলা প্রকল্পের মূল লক্ষ্য শুধুমাত্র পুষ্টি সরবরাহ নয়, বরং কিশোরীদের সার্বিক উন্নয়ন। এই উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল—
- পুষ্টি উন্নয়ন – কিশোরীদের জন্য বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা।
- স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি – শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, কৈশোরকালীন সমস্যার মোকাবিলা শেখানো।
- বৃত্তিমূলক দক্ষতা বৃদ্ধি – সেলাই, হস্তশিল্প, বিউটিশিয়ান, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ।
- জীবন দক্ষতা শিক্ষা – আত্মবিশ্বাস তৈরি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধান ও নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন।
- বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা – যারা পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে তাদের আবার শিক্ষায় যুক্ত করা।
- নারী ক্ষমতায়ন – মেয়েদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করে তোলা।
সবলা প্রকল্পের যোগ্যতা, Eligibility for Sabala Prakalpa :
সবলা প্রকল্পের সুবিধা নিতে হলে আবেদনকারীর কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলি হলো—
- বয়স ১১ থেকে ১৮ বছর হতে হবে।
- কিশোরীকে অবশ্যই অবিবাহিতা হতে হবে।
- সে কোনও বিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রী হতে হবে (বিদ্যালয় বহির্ভূতদের ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা রয়েছে)।
- শুধুমাত্র সাতটি জেলার (কলকাতা, কোচবিহার, নদিয়া, জলপাইগুড়ি, পুরুলিয়া, মালদা, আলিপুরদুয়ার) মেয়েরা এই প্রকল্পের আওতায় আসবে।
সবলা প্রকল্পে আবেদনের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস, Documents required for applying for the Sabala project :
সবলা প্রকল্পে আবেদন করার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলি হল:
- পরিচয়পত্র – আধার কার্ড / ভোটার কার্ড / প্যান কার্ড
- জন্ম সনদ (Birth Certificate)
- স্কুলের আইডি কার্ড (যদি স্কুলে পড়াশোনা করে)
- আবাসিক প্রমাণপত্র – রেশন কার্ড অথবা বাসস্থান সনদ
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি
সবলা প্রকল্পের সুবিধা, Benefits of Sabala Prakalpa :
- পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ : ১১ থেকে ১৮ বছরের কিশোরীরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাবার পায়।
- স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা : মেয়েদের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু সুরক্ষা বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান দেওয়া হয়।
- বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ : বিউটিশিয়ান কোর্স, হস্তশিল্প, সেলাই, ডাইং, প্রিন্টিং, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
- কিশোরী কার্ড প্রদানা : প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী কিশোরীকে একটি ‘কিশোরী কার্ড’ দেওয়া হয়, যাতে তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য থাকে।
- শিক্ষা ও জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি : বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয় এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় দক্ষতা শেখানো হয়।
- কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় : কন্যাশ্রী প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত বহু কিশোরীও সবলা প্রকল্পের মাধ্যমে পরিপূরক পুষ্টি পেয়ে থাকে।
সবলা প্রকল্পের কর্মপদ্ধতি, Sabla Project Procedure :
- প্রকল্পের কাজ প্রধানত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং ব্লকের সিডিপিও (Child Development Project Officer)-র মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
- প্রতিটি কিশোরীকে নির্দিষ্ট অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করা হয়।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্য সরবরাহ করা হয়।
- প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে বৃত্তিমূলক কোর্স করানো হয়।
- শিক্ষার বাইরে থাকা কিশোরীদের আবার পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
- প্রকল্প বাস্তবায়নে ICDS (Integrated Child Development Services) এবং স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সবলা প্রকল্পের সাফল্য ও প্রভাব, The success and impact of the Sabala project :
সবলা প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বহু কিশোরী বাস্তব সুবিধা পেয়েছে।
- প্রায় ১২.৭২ লক্ষ কিশোরী প্রকল্পের আওতায় এসেছে।
- বিদ্যালয় ছুটের হার ২০১০-১১ সালে ২.৮ লক্ষ থেকে কমে ২০১৬-১৭ সালে ৯২,০০০ হয়েছে।
- প্রায় ৪১ হাজার বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোরী বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
- প্রায় ১৬০০ কিশোরী পুনরায় স্কুল বা অপ্রথাগত শিক্ষায় ভর্তি হয়েছে।
- কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ৯৮,৮২০ কিশোরী সবলা প্রকল্প থেকে পরিপূরক পুষ্টি পেয়েছে।
এছাড়া গ্রামীণ বাংলায় কিশোরীদের মধ্যে স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা, আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরতার ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে।
সবলা প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা, Challenges and limitations of the Sabala project :
যদিও সবলা প্রকল্পের প্রভাব ইতিবাচক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—
- অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামোগত সমস্যা।
- গ্রামীণ সমাজে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রথা এখনও পুরোপুরি কমেনি।
- বিদ্যালয় বহির্ভূত মেয়েদের পুনরায় পড়াশোনায় যুক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।
- অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পের সুবিধা সব জেলায় এখনও প্রসারিত হয়নি।
সবলা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, Future prospects of the Sabala project :
সবলা প্রকল্প ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ ও শহুরে কিশোরীদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে। আগামী দিনে—
আরও বেশি জেলায় এই প্রকল্প চালু করা হলে কন্যাশিশুদের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার শিক্ষা, অনলাইন দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ যোগ করলে আধুনিক যুগে মেয়েরা আরও স্বনির্ভর হবে।
কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি অন্যান্য নারী-কেন্দ্রিক প্রকল্পের সঙ্গে একত্রে কাজ করলে এর প্রভাব আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার
এক কথায়, সবলা প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের কিশোরীদের জন্য এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। এই প্রকল্প কেবলমাত্র পুষ্টি নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৃত্তিমূলক দক্ষতা এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে কিশোরীদের সুস্থ, সবল ও স্বনির্ভর করে তুলছে।
ভারতের মতো দেশে যেখানে কন্যাশিশু এখনও বহু ক্ষেত্রে অবহেলিত, সেখানে সবলা প্রকল্প মেয়েদের সম্মান ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের বিস্তার হলে সমাজের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর হবে এবং কন্যাশিশুরা আত্মনির্ভর হয়ে দেশের উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।