যোগব্যায়াম আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অমূল্য অংশ। এটি শুধু শরীর নয়, মন ও আত্মার সুসমন্বয় সাধন করে। যোগব্যায়ামের বিভিন্ন আসনের মধ্যে “সেতু বন্ধাসন” একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। এর ইংরেজি নাম “Bridge Pose”। এটি শরীরের নমনীয়তা বৃদ্ধি করে, মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখে এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। এই রচনায় আমরা সেতু বন্ধাসন কী, কীভাবে করা হয়, এর উপকারিতা, সতর্কতা এবং প্রয়োজনীয় দিক নিয়ে আলোচনা করব।
“সেতু” শব্দের অর্থ হলো সেতু বা ব্রিজ এবং “বন্ধ” অর্থ বন্ধন বা স্থিতিশীলতা। এই আসনে শরীর একটি উঁচু সেতুর মতো আকৃতি ধারণ করে বলে এর নাম হয়েছে সেতু বন্ধাসন। এটি একটি ব্যাকবেন্ডিং আসন, যা মূলত শুয়ে থেকে করা হয় এবং মেরুদণ্ড, কোমর, হাঁটু ও ঘাড়ের উপর কার্যকর প্রভাব ফেলে।এটি Backbends আসনের অন্যতম রূপ।
Backbends কী?
Backbends হলো শরীরকে পেছনের দিকে বাঁকিয়ে একটি গভীর খিলান (arch) তৈরি করার একটি শারীরিক আন্দোলন। এটি জিমন্যাস্টিকস, যোগব্যায়াম এবং আইস স্কেটিং-এর মতো বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপে ব্যবহৃত হয়। ব্যাকবেন্ড মেরুদণ্ডকে প্রসারিত করে নমনীয়তা বাড়ায় এবং শরীরের মূল অংশকে শক্তিশালী করে।

সেতু বন্ধাসনের ইতিহাস ও উৎস, History and origins of Setu Bandhasana
সেতু বন্ধাসনের মতো আসনগুলি প্রাচীন ভারতের যোগব্যায়ামের গ্রন্থসমূহে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে। যদিও এই আসনের নির্দিষ্ট নাম “সেতু বন্ধাসন” হিসাবে “হঠযোগ প্রদীপিকা” বা “ঘেরণ্ড সংহিতা”-তে সেভাবে উল্লেখ নেই, তবে ব্যাকবেন্ডিং জাতীয় আসনের বর্ণনা সেখানে রয়েছে।
এই আসনের আধুনিক ব্যাখ্যা এবং প্রচলন ঘটে বিংশ শতকের শুরুতে, বিশেষত যোগগুরু শ্রী তিরুমালাই কৃষ্ণমাচার্য ও তাঁর শিষ্য বি. কে. এস. আয়েঙ্গার এবং পতঞ্জলি জয়ানতি-র মতো যোগগুরুদের মাধ্যমে।
তারা যোগাসনগুলিকে আধুনিক জীবনযাত্রার উপযোগী করে তোলেন এবং শরীরের সঙ্গে মনের সুসমন্বয় ঘটানোর উপায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলেন।বি. কে. এস. আয়েঙ্গারের যোগশিক্ষা পদ্ধতিতে সেতু বন্ধাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে পরিচিত। আয়েঙ্গার সাহেব তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “Light on Yoga”-তে এই আসনের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং এর উপকারিতা ব্যাখ্যা করেছেন।
বিশ্বজুড়ে যোগব্যায়ামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেতু বন্ধাসনও যোগপ্রেমীদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রচলিত হয়েছে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন বা মানসিক চাপ অনুভব করেন, তাদের জন্য এই আসন অত্যন্ত উপকারী বলে ধরা হয়।আজকের দিনে, সেতু বন্ধাসন শুধুমাত্র শারীরিক অনুশীলন নয়, বরং একটি মানসিক ও আধ্যাত্মিক চর্চার অংশ হিসেবেও বিবেচিত।

সেতু বন্ধাসনের পদ্ধতি, The method of Setu Bandhasana
নীচে সেতু বন্ধাসনের পদ্ধতি দেওয়া হল:-
- প্রথমে, একটি মাদুর বা নরম জায়গায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
- তারপর পা দুটি ভাঁজ করে, হাঁটু মুড়ে এবং পায়ের পাতা মেঝেতে রাখতে হবে।
- এরপর হাত দুটি শরীরের পাশে সোজা করে রাখতে হবে।
- তারপর শ্বাস নিতে নিতে কোমর ও নিতম্ব মাটি থেকে উপরে তুলে একটি সেতু তৈরি করতে হবে।
- এরপর মেরুদণ্ড সোজা রেখে, কাঁধ ও মাথা মেঝেতে লাগাতে হবে।
- এই অবস্থায় কয়েক সেকেন্ড থেকে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে।
- এরপর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ধীরে ধীরে কোমর ও নিতম্ব নামিয়ে এনে আরাম করতে হবে।
Also check out: গুগল ম্যাপ কি
সেতু বন্ধাসনের ছবি, Setu Bandhasana
Picture
নীচে সেতু বন্ধাসনের কয়েকটি ছবি দেওয়া হল:-

সেতু বন্ধাসনের শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা, Physical and mental benefits of Setu Bandhasana
সেতু বন্ধাসন শুধু শরীরকেই সুস্থ রাখে না এটি মনকেও ভালো রাখে।
সেতু বন্ধাসনের কয়েকটি শারীরিক উপকারিতা নীচে দেওয়া হল:-
- পিঠ ও পেটের পেশী শক্তিশালী করে: এই ভঙ্গিটি মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করে এবং কোমর ও পিঠের পেশীগুলিকে মজবুত করে, যা আধুনিক জীবনযাত্রায় শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- নমনীয়তা বাড়ায়: এটি শরীরের পেশীগুলিকে প্রসারিত করে, বিশেষ করে বুক, কাঁধ এবং উরুর নমনীয়তা বৃদ্ধি করে।
- হজমের উন্নতি ঘটায়: সেতু বন্ধাসন হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
- ফুসফুসের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে: এই আসনটি ফুসফুসে আরও বেশি বাতাস পাম্প করতে সাহায্য করে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসকে উন্নত করে।
- শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে: এটি মূল চক্র, ত্রিকাকৃতি চক্র এবং মণিপুর চক্রকে সক্রিয় ও ভারসাম্যপূর্ণ করে শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা বাড়ায়।
- শরীরের ভঙ্গি উন্নত করে: নিয়মিত অনুশীলনের ফলে এটি শরীরের ভঙ্গি উন্নত করতে সাহায্য করে।
সেতু বন্ধাসনের মানসিক উপকারিতা নীচে দেওয়া হল:-
- মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমায়: এটি মনকে শান্ত করে এবং মানসিক চাপ ও উদ্বেগের অনুভূতি কমায়, যা এটিকে একটি কার্যকর প্রশান্তিদায়ক ভঙ্গি করে তোলে।
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে: এটি মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে সাহায্য করে, যার ফলে আরও ভালো মনোযোগ এবং মানসিক স্বচ্ছতা আসে।
- মানসিক ভারসাম্য ও শক্তি বৃদ্ধি করে: সেতুবন্ধাসন শুধু শারীরিক শক্তিই নয়, মানসিক শক্তি ও ভারসাম্যও বাড়াতে সাহায্য করে।
সেতু বন্ধাসন কতবার করা উচিত? How often should Setu Bandhasana be done?
সেতু বন্ধাসন সাধারণত প্রতিদিন ৩-৫ বার বা আপনার শরীরের ক্ষমতা অনুযায়ী করা যেতে পারে। তবে, প্রতিটি আসনের সময়কাল ১৫-৩০ সেকেন্ড হওয়া উচিত এবং শক্তি ও নমনীয়তা বাড়ার সাথে সাথে এই সময় বাড়ানো যেতে পারে।

সেতু বন্ধাসনের সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা, Warnings and prohibitions of Setu Bandhasana
সেতু বন্ধাসনের কয়েকটি সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা নীচে দেওয়া হল:
- যদি আপনার পিঠে, ঘাড় বা কোমরে কোনো গুরুতর আঘাত বা ব্যথা থাকে, তাহলে এই আসন করা এড়িয়ে চলুন।
- উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ থাকলে এই আসন করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই আসন করার আগে অবশ্যই একজন প্রশিক্ষিত যোগ শিক্ষকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- প্রথমদিকে খুব বেশি চাপ না নিয়ে ধীরে ধীরে এই আসন অভ্যাস করুন।
- যদি অনুশীলনের সময় কোনো অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ আসনটি বন্ধ করুন।
- একজন অভিজ্ঞ যোগ প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে এই আসন অনুশীলন করা ভালো, বিশেষ করে যদি আপনি নতুন হয়ে থাকেন।
- যদি আপনার রক্তচাপ সম্পর্কিত কোনো সমস্যা থাকে, তবে এই আসন করার সময় মাথা যেন পেটের উপর না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
পরিশেষে
সেতু বন্ধাসন একটি সহজ ও কার্যকর যোগাসন, যা শরীর ও মনের ওপর সমানভাবে প্রভাব ফেলে। প্রতিদিনের জীবনে মাত্র কয়েক মিনিট এই আসন চর্চা করলে অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।তবে যেকোনো যোগাসনের মতোই, এটি করার সময় সঠিক পদ্ধতি ও নিয়ম মেনে চলা উচিত। উপযুক্ত নির্দেশনার মাধ্যমে নিয়মিত অনুশীলনে সেতু বন্ধাসন জীবনের গুণগত মান উন্নত করতে সক্ষম।
সুস্থ ও সচল জীবনের জন্য যোগব্যায়ামের অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি। সেতু বন্ধাসনের মতো আসন আমাদের শরীরকে যেমন সুস্থ রাখে, তেমনি মনের ওপরও প্রশান্তি বয়ে আনে। অতএব, আসুন আমরা নিয়মিত যোগাসনের অনুশীলন করে নিজের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হই।আশা করছি আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের পছন্দ হবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে এই পোস্টটি আপনি আপনাদের বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও চেনা পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারেন।