বর্তমান সময়ে সুস্থ ও সুগঠিত জীবনযাপন নিশ্চিত করতে যোগব্যায়াম একটি অপরিহার্য উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে যোগব্যায়ামের নানা ধরনের আসন বা ব্যায়াম আছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো “বিপরীত করণী আসন”।এটি একটি সহজ, আরামদায়ক ও অত্যন্ত উপকারী যোগাসন। নামেই বোঝা যায়, এটি এমন একটি আসন, যেখানে দেহকে বিপরীত বা উল্টোদিকে স্থাপন করা হয়। এই আসনের নিয়মিত চর্চা শারীরিক এবং মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
“বিপরীত” শব্দের অর্থ উল্টো, আর “করণী” অর্থ কার্য বা কৌশল। তাই “বিপরীত করণী” বলতে বোঝায় এমন একটি যোগাসন বা কৌশল, যেখানে শরীরকে উল্টো করে স্থাপন করা হয়।সাধারণত এই আসনে মাটিতে শুয়ে পা দুটি উপরের দিকে তুলে দেয়াল বা অন্য কোনো সমর্থনের ওপর রাখা হয়। এটি একটি আধা-বিপরীত অবস্থান, যা শরীরের উপরিভাগকে নিচের দিকে এবং নিচের অংশকে উপরের দিকে রাখে। এটি Inversion আসনের অন্যতম রূপ।
Inversion কী?
ইনভার্সন (Inversion) আসন হল যোগের এমন একটি ভঙ্গি যেখানে শরীরকে উল্টো করে মাথাকে হৃদপিণ্ড বা নিতম্বের নিচে রাখা হয়, যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উল্টে দেয়। এই আসনগুলি রক্ত প্রবাহ বাড়াতে, মনোযোগ এবং সতর্কতা বৃদ্ধি করতে এবং শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে পারে।
বিপরীত করণী আসনের ইতিহাস ও উৎস, History and origins of Viparita Karani Asana
বিপরীত করণী আসনের উল্লেখ আমরা পাই “হঠ যোগ প্রদীপিকা” (Hatha Yoga Pradipika)-তে, যা ১৫শ শতকে স্বামী স্বাত্মারাম কর্তৃক রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগগ্রন্থ।এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে বিপরীত করণী মুদ্রা চর্চার মাধ্যমে শরীরের প্রাণশক্তি (প্রাণ) মাথার দিকে প্রবাহিত হয়, যা দীর্ঘায়ু, রোগপ্রতিরোধ ও মানসিক উন্নতিতে সহায়তা করে।
প্রাচীনকালে যোগীরা বিপরীত করণী মুদ্রা বা আসনকে ধ্যানের একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতেন। এটির মাধ্যমে তারা শরীরের রক্ত ও প্রাণশক্তিকে মস্তিষ্কের দিকে প্রবাহিত করে মানসিক স্বচ্ছতা ও আত্মজ্ঞানে অগ্রসর হতেন।বিশেষ করে তপস্বীরা বিশ্বাস করতেন, এই আসন তাদের ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি করে এবং শারীরিক ক্লান্তি দূর করে। ধীরে ধীরে এটি শুধু ধ্যানের মুদ্রা হিসেবে নয়, একটি চিকিৎসাশাস্ত্রভিত্তিক ব্যায়াম হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বর্তমান যুগে, যোগব্যায়াম যখন বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যচর্চার অংশ হয়ে উঠেছে, তখন বিপরীত করণী আসনও একটি “রিস্টোরেটিভ যোগ” (Restorative Yoga) আসন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আধুনিক যোগশিক্ষকরা এটি মানসিক চাপ, অনিদ্রা, হজমজনিত সমস্যা এবং রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখতে অত্যন্ত কার্যকর বলে বিবেচনা করেন।বিশ্বখ্যাত যোগগুরু বি. কে. এস. আইয়েঙ্গার (B.K.S. Iyengar) এই আসনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, এটি এমন একটি আসন, যা অল্প পরিশ্রমে সর্বোচ্চ বিশ্রাম ও উপকার নিয়ে আসে।

বিপরীত করণী আসনের পদ্ধতি, The method of Viparita Karani Asana
নীচে বিপরীত করণী আসনের পদ্ধতি দেওয়া হল:-
- প্রথমে চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন।
- পা দুটি একসাথে করে উপরের দিকে তুলুন।
- নিতম্ব দুটিকে দুই হাতের তালু দিয়ে ঠেলে ধরুন।
- হাতের কনুই দুটিকে শরীরের কাছাকাছি রাখুন এবং কোমর থেকে পা সোজা রাখুন।
- কিছু ক্ষেত্রে, ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাথাকে সামান্য ঢালু করে অভ্যাস করা যেতে পারে।
বিপরীত করণী আসনের ছবি, Viparita Karani Asana Picture
নীচে বিপরীত করণী আসনের কয়েকটি ছবি দেওয়া হল:-

বিপরীত করণী আসনের শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা, Physical and mental benefits of Viparita Karani Asana
বিপরীত করণী আসন শুধু শরীরকেই সুস্থ রাখে না এটি মনকেও ভালো রাখে।
বিপরীত করণী আসনের কয়েকটি শারীরিক উপকারিতা নীচে দেওয়া হল:-
- রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি: এই আসনটি শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে পায়ে রক্ত চলাচল উন্নত করে।
- পেশি ও স্নায়ু শক্তিশালীকরণ: এটি পেশি ও স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, যার ফলে সামগ্রিক শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- নমনীয়তা বৃদ্ধি: নিয়মিত অনুশীলনে শরীরের নমনীয়তা বাড়ে।
- বার্ধক্য প্রতিরোধ: এই আসনটি বার্ধক্য-বিরোধী প্রভাব ফেলে এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
- ওজন কমাতে সহায়তা: এটি শরীরের বিপাক ক্রিয়া বাড়িয়ে ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- হজমে সহায়তা: হজম প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটাতে এবং পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এটি সাহায্য করে।
পিঞ্চা ময়ূরাসনের শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা
বিপরীত করণী আসনের কয়েকটি মানসিক উপকারিতা নীচে দেওয়া হল:-
- মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাস: এই আসনটি মানসিক চাপ কমাতে এবং উদ্বেগ উপশম করতে সাহায্য করে, যা মনকে শান্ত ও শিথিল রাখে।
- মস্তিষ্কের অবসাদ দূর করে: মস্তিষ্কের ক্লান্তি বা অবসাদ কমাতে বিপরীত করণী খুব উপকারী।
- নার্ভাস টেনশন কমায়: স্নায়ুর উত্তেজনা বা নার্ভাস টেনশন কমাতে এই আসনটি সাহায্য করে।
- মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করে: এটি শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
- ঘুমের উন্নতি: যারা অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য এটি উপকারী হতে পারে।

বিপরীত করণী আসন কতবার করা উচিত? How often should Viparita Karani Asana
be done?
বিপরীত করণী আসনটি আপনি ৫ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত করতে পারেন। এটি একটি বিশ্রামদায়ক আসন, তাই এটিকে আসন অনুশীলনের শেষে করা ভালো। আপনার শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী ও সুবিধা অনুযায়ী এর সময়কাল বাড়াতে পারেন বা কমাতে পারেন।
বিপরীত করণী আসনের সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা, Warnings and prohibitions of Viparita Karani Asana
বিপরীত করণী আসনের কয়েকটি সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা নীচে দেওয়া হল:
- উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের এই আসন করা উচিত নয়।
- হার্ট অ্যাটাক, গ্লুকোমা বা অন্যান্য চোখের সমস্যা থাকলে এই আসন এড়িয়ে চলুন।
- গর্ভবতী মহিলা এবং মাসিকের সময় মহিলাদের জন্য এটি নিষিদ্ধ। যদি গর্ভবতী হন, তবে এই আসন করার আগে একজন পেশাদার যোগ প্রশিক্ষকের সাথে পরামর্শ করুন।
- যদি শ্বাসকষ্ট হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এই আসন বন্ধ করুন।
- পেটে বা শরীরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এমন কোনো আসন করা থেকে বিরত থাকুন।
- যদি কোনো আসন করার সময় ব্যথা বা অস্বস্তি হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা করা বন্ধ করুন।
- যদি আপনার কোনো গুরুতর অসুস্থতা থাকে, তবে যেকোনো যোগাসন, বিশেষ করে বিপরীত করণী করার আগে একজন অভিজ্ঞ যোগ প্রশিক্ষকের বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- আসনটি করার সময় হঠাৎ অস্বস্তি, ব্যথা, বা শ্বাসকষ্ট হলে আসনটি বন্ধ করুন।

পরিশেষে
বিপরীত করণী আসন একটি সরল অথচ অত্যন্ত কার্যকর যোগাভ্যাস, যা দেহ ও মনের ভারসাম্য রক্ষা করে। আধুনিক জীবনের চাপ, মানসিক উদ্বেগ ও শারীরিক ক্লান্তির বিরুদ্ধে এটি এক প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর প্রতিকার। নিয়মিত এই আসন চর্চা করলে শরীরের রক্তসঞ্চালন ভালো হয়, মন শান্ত থাকে এবং শরীর সতেজ থাকে।
বিপরীত করণী আসন কেবল একটি ব্যায়াম নয়, এটি ভারতীয় যোগচর্চার গভীর ঐতিহ্য বহনকারী এক অনন্য ভঙ্গি। প্রাচীন যোগী ও সাধকরা একে যেমন আত্মোন্নতির মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন, তেমনি আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসা এটিকে মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত কার্যকর বলেছে।
এর ইতিহাস আমাদের শেখায় সুস্থতা কেবল বাহ্যিক নয়, এটি আভ্যন্তরীণ ভারসাম্য ও চেতনারও অংশ।
আশা করছি আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের পছন্দ হবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে এই পোস্টটি আপনি আপনাদের বন্ধু, আত্মীয় স্বজন ও চেনা পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারেন।