অটিস্টিক শিশু কারা, Who are autistic children in Bengali?

অটিজম

একটা শিশুর জন্মের পর তার শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশেও যথেষ্ট যত্ন নেওয়া জরুরি। এসব বিষয়ে অযত্ন আর অবহেলায় কিংবা খামখেয়ালিতে আপনার শিশুর কি সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করতে দেরি করলে সমস্যা সমাধান করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। জন্মের পর শিশুরা বিভিন্ন রোগে ভুগতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা এমনও আছে যার চিকিৎসা যথাসময়ে না করলে শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনই একটি রোগ হল অটিজম। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা অটিস্টিক শিশু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। 

অটিজম কী ও এর লক্ষণ সমূহ, What is autism and its symptoms

অটিজম মূলত শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি সমস্যা। এক্ষেত্রে শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া অন্য স্বাভাবিক শিশু থেকে কিছুটা ভিন্ন হয়। চিকিৎসকদের মতে একটি শিশুর জন্মের ৩ বছরের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথম ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত এই সমস্যার কোনো লক্ষণ বোঝা যায় না। ১৮ মাসের পর থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যে একটা শিশুর মধ্যে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যা বুঝিয়ে দেয় যে আপনার শিশু অটিজমের শিকার। যেমন-

অটিজম কী ও এর লক্ষণ সমূহ
Autistic child playing with a string and a yellow toy car against a blue wall with copy space
  • ১. কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে শিশু অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চায় না। অন্য শিশুদের থেকে সবসময় আলাদা হয়ে থাকে।
  • ২. সবসময় নিজের মতো করে চলতে চায়, নিজের যা মন চায় শুধু তাই করে।
  • ৩. এই শিশুরা মায়ের সঙ্গে বা অন্য কারো সঙ্গে কথাবার্তা বললেও ১৮ মাস বয়সে এসে কথা বলা কমে যেতে থাকে।
  • ৪. শিশু অন্যের সঙ্গে কথা কমে যাওয়ার পাশাপাশি নিজের সাথে নিজে কথা বলা শুরু করে দেয়।
  • ৫. শিশুটি কেউ ডাকলে সাড়া দেয় না, পাশাপাশি কারও কোনো কথায় কোনোও ধরনের প্রতিক্রিয়া দেয় না।

উপরিউক্ত লক্ষণগুলো ছাড়া আরও কিছু নির্দিষ্ট অসুবিধা দেখা যায়, যা প্রথমে না থাকলেও ১৮ মাস বয়সের পরের দিকে এই আচরণগত পরিবর্তনগুলো পরিলক্ষিত হয়। যেমন-

  • ১. শিশুটি একই কাজ বারবার করতে থাকে।
  • ২. একই খেলা বারবার খেলতে চাইবে।
  • ৩. বেশিরভাগ সময় একইভাবে কিছু অঙ্গভঙ্গি করতে থাকবে।
  • ৪. কিছু নির্দিষ্ট জিনিসের মধ্যে শিশুটির স্বার্থ সীমাবদ্ধ থাকে।
  • ৫. নির্দিষ্ট জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই পরতে চায় না।
  • ৬. খাবার সঠিকভাবে খেতে চায় না, নির্দিষ্ট পছন্দের বাইরে কোনো খাবার খাওয়ানো যাবে না শিশুকে।
একই খেলা বারবার খেলতে চাইবে

এক কথায় বলতে গেলে পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণের প্রবণতা দেখা যায় শিশুর মধ্যে। শিশুটির একই কাজ করার প্রবণতা থাকে, যা করতে না দেওয়া হলে শিশুটি আক্রমণাত্মক হয়ে যায়।

অটিজমের কারণ কি ? Causes of Autism

অটিজমের কারণ জানতে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। অটিজম মূলত জিনগত সমস্যা ও পরিবেশগত সমস্যা থেকে হয়।

জিনগত অসুবিধা :

শিশু যখন ভ্রুণ অবস্থায় থাকে তখন থেকেই তার জিনে এই অসুবিধা থাকে। তবে দেড় বছর বয়স হওয়ার আগে এই সমস্যা সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায় না। জন্ম থেকেই এই অসুবিধা নিয়ে আসে শিশুরা। তবে সবার মধ্যে যে একইভাবে অসুবিধাগুলো প্রকাশ পাবে এমনটাও নয়, কারো ক্ষেত্রে অসুবিধা বেশি প্রকাশ পায় আবার কারো মধ্যে খুব কম। এর কারণ হচ্ছে পরিবেশগত অসুবিধা। তাই অনেক সময় মা বাবা বুঝতেই পারেন না যে তাদের শিশু এই অসুবিধায় ভুগছেন।

পরিবেশগত অসুবিধা :

শিশুটি কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে এবং তার জিনগত অসুবিধাগুলো কতটা প্রকাশ পাওয়ার সুযোগ হয়েছে এটা নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজম গ্রামীণ এলাকায় কম হয় এবং শহরে বেশি দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি মানুষের মধ্যে খোলামেলা জীবনে বড় হয়।

অটিজম গ্রামীণ এলাকায় কম হয় এবং শহরে বেশি দেখা যায়।

অন্যদিকে শহরের শিশুরা চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, বেশি মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায় না, এমনকি অভিভাবকরাও তাদের ব্যস্ত জীবন যাপনের কারণে শিশুকে এত বেশি সময় দিতে পারেন না, ফলে শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিশুরাই নিজেই নিজের খেলার সঙ্গী হয়, ফলে তার একা থাকার অভ্যাস হয়ে যায় এবং অন্যদের সাথে আর মিশতে ভালো লাগে না।

এভাবেই পরিবেশগত কারণে অভিভাবক অটিজমের সমস্যার লক্ষণগুলো নিজের শিশুর মধ্যে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে পারেন না, ফলে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রেও দেরি হয়ে যায়, যার কারণে অনেকের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

কিভাবে বুঝবেন আপনার শিশুর অটিজমের সমস্যা আছে, How to know if your child has autism

 গবেষণায় দেখা গেছে ছেলে শিশুদের মধ্যে অটিজম বেশি, মেয়ে শিশুদের মধ্যে কম। শিশু ৬ মাস বয়স থেকেই কথা বলার প্রবণতা তথা চেষ্টা শুরু করে দেয়। বাবলিং সাউন্ড যেমন- বাবা, মা, দাদা ইত্যাদি উচ্চারণ করার চেষ্টা করে। ১ বছর বয়স হলে ধীরে ধীরে মা-বাবাকে চিনতে শুরু করে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেওয়া তথা পরিচিত শব্দ উচ্চারণ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে ছেলে শিশুদের মধ্যে অটিজম বেশি, মেয়ে শিশুদের মধ্যে কম।

২ বছর বয়স হতে হতে স্বাভাবিক শুধু ছোট ছোট ২টি শব্দ একসঙ্গে উচ্চারণ করে বাক্য তৈরি করতে শুরু করে; যেমন- আমি খাব, আমি যাব ইত্যাদি বলতে পারে। যদি ১ বছর বয়সের মধ্যে শিশু বাবা-মা না বলতে পারে অথবা ২ বছর বয়স হতে হতে ছোট শব্দ উচ্চারণ করা বা দুই শব্দের বাক্য গঠন করতে না পারে তবে এটা অবশ্যই চিন্তার কারণ।

এসব ছাড়াও কোনো কারণে যদি শিশুর আচরণে কোনো অসুবিধা বা অস্বাভাবিকতা, যেমন- কারণ ছাড়াই আগ্রাসী আচরণ, কারণ ছাড়াই মায়ের সঙ্গে কান্নাকাটি করা, অন্য শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা না করা ইত্যাদি আচরণ দেখা দেয় তখন বুঝতে হবে শিশুটি অটিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করছে।

শিশুর আচরণে কোনো অসুবিধা বা অস্বাভাবিকতা, যেমন- কারণ ছাড়াই আগ্রাসী আচরণ

২ বছরের যেকোনো শিশুর যদি কানে কোনো সমস্যা না থাকে তবে সে ডাক দিলে অবশ্যই সাড়া দেবে এবং প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে শিশুটি যদি ডাকলে সাড়া না দেয় অথবা কেউ তাকে কিছু বললে যদি চোখে চোখ না রাখে, চোখ আড় করে কথা শোনে বা যেকোনো প্রতিক্রিয়া দেয় তাহলে বুঝতে হবে এগুলো অটিজমের বৈশিষ্ট্য।

অটিজমের চিকিৎসা, Treatment of Autism

চিকিৎসকদের মতে ৩ বছরের আগে অটিজম পুরোপুরি শনাক্ত করা যায় না। ৩ বছরের মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো শিশুর মধ্যে প্রকাশ পায়। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসায় অনেক বেশি ওষুধ ব্যবহার করা হয় না; বরং কিছু অভ্যাস নিয়মিত মেনে চলার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়, আর পাশাপাশি খাবারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। যেমন :

  • যেহেতু অটিস্টিক শিশু কথা বলে না, তাই তাকে স্পিচ থেরাপি দেওয়া হয়। 
  • যেহেতু আচরণের পরিবর্তন হয়, তাই ব্যবহারিক কিছু ব্যায়াম শেখানোর চেষ্টা করা হয়। 
  • অটিজমের সঙ্গে শিশু যদি অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়, শিশুর যদি মাঝে মাঝে খিঁচুনি ধরার সমস্যা হয়ে থাকে, শিশুর যদি ঘুমের সমস্যা থাকে তাহলে সেই শিশুর ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ওষুধগুলো ব্যবহার করলে ওই সমস্যাগুলো দূর হলে অটিজমের মাত্রা কমে যায়।
  • অভিভাবকদের কোনো শিশু নিউরোলজিস্ট বা শিশু মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ নেওয়া উচিত, যায় অটিস্টিক শিশুর মানসিক বিকাশে কোনো সমস্যা না হয়।
  • অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের সঙ্গে সবার ইতিবাচক আচরণ করতে হবে।
  • মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে শিশুকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি তেলে ভাজা খাবার যেন না খায় বা খুবই কম খায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • দৈনিক সকল কাজ নিয়ম মেনে করানোর অভ্যাস রাখতে হবে।
  • সামাজিক অনুষ্ঠানে হোক কিংবা বেশি মানুষের সাথে শিশুর মেলামেশা করানোর চেষ্টা করুন, যেন তার মানুষের মধ্যে থেকে তাদের সঙ্গে মিশে কথা বলার মত প্রবণতা বেড়ে যায়।  
যেহেতু অটিস্টিক শিশু কথা বলে না, তাই তাকে স্পিচ থেরাপি দেওয়া হয়। 

শেষ কথা, Conclusion 

 অটিজম কখনোই একবারে ভালো হয় না, এটি সারাজীবন শিশুর সাথে চলবে। তবে অটিজমের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যায় যদি শিশুর প্রথম ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। ৫ বছরের পরে এই সমস্যায় জর্জরিত শিশুর বৈশিষ্ট্যের তেমন বেশি পরিবর্তন হয় না। তাই অটিজমের অসুবিধাগুলো সঠিক সময়ে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারলে  অনেকাংশেই  অটিজমের সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts