শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী, Sarat Chandra Chattopadhyay Biography in bengali

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার, যিনি বাংলা সাহিত্যে সামাজিক সংস্কার, শ্রেণীসংগ্রাম ও নারী অধিকার নিয়ে লেখার জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি তার জীবন ও লেখনীর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে দেবদাস এবং পথের দাবি। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা প্রথিতযশা লেখকের জীবন কাহিনী তুলে ধরব।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু তথ্য, Some information about Sarat Chandra Chatterjee :

  • জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ সালে (বাংলা: ৩১ ভাদ্র ১২৮৩) তাঁর জন্ম হয়।
  • জন্মস্থান (Birthplace) : দেবানন্দপুর, ব্যান্ডেল, হুগলি জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
  • পিতা ও মাতা: তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী।
  • পরিবার: তিনি তাঁর পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন।
  • সাহিত্যিক প্রভাব: তিনি ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলাকে তাঁর লেখালিখির গুরু মানতেন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নাম
  • শৈশব শিক্ষা → দেবানন্দপুরের পাঠশালা → ভাগলপুর দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয় → ভাগলপুর জেলা স্কুল → হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল → তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল।
  • ১৮৯৪ খ্রিঃ → এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন।
  • কলেজে পড়ার খরচ অঘোরনাথের সহায়তায় চালালেও এফএ পরীক্ষার ফি দিতে না-পারায় পরীক্ষা দিতে পারেননি।
  • কলেজ ছাড়ার পর আদমপুর ক্লাবের নাটক-খেলাধুলায় যুক্ত হন ও গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করেন।
  • কিছুদিন বনেলী রাজ এস্টেটে চাকরি করেন, পরে অভিমানে ঘর ছেড়ে সন্ন্যাসী সেজে চলে যান।
  • পিতার মৃত্যুর পর কলকাতায় এসে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের চাকরি পান (৩০ টাকা বেতন)।
  • ১৯০৩ খ্রিঃ → রেঙ্গুনে যান; অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় চাকরি পান।
  • ১৯০৬–১৯১৬ খ্রিঃ → রেঙ্গুনের পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসে চাকরি।
  • ১৯১৬ খ্রিঃ → চাকরি ছেড়ে বাংলায় ফিরে আসেন।

চাকরি জীবন চলাকালীন তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং বাংলায় ফিরে একের পর এক অনবদ্য রচনার সৃষ্টি অব্যাহত রাখেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস কয়টি? / শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস pdf / শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসের নাম / শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নাম :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মোট প্রায় তিরিশটির কাছাকাছি উপন্যাস লিখেছেন, যেখানে তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘বড়দিদি’ (১৯১৩) এবং শেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘বিপ্রদাস’ (১৯৩৫)। তাঁর উপন্যাসগুলো সামাজিক সমস্যা, প্রেম, নৈতিকতা এবং মানবিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে রচিত। তাঁর লেখা কিছু বিখ্যাত উপন্যাসের নাম হলো: পরিণীতা (১৯১৪), পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (চারখণ্ডে ১৯১৭-১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) এবং শুভদা। তাঁর এই উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। এই উপন্যাসগুলো শরৎচন্দ্রকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মুদ্রিত কাজ ছিল “মন্দির” (১৯০৩), কিন্তু তাঁর প্রথম উপন্যাস “বড়দিদি” (১৯১৩) যা ১৯১৩ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত লেখকের নামে প্রকাশিত প্রথম রচনা। রচনাটি দশটি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত। ১৩১৪ বঙ্গাব্দ (১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে) সরলা দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকার বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশিত হয়।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি, তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, অনেক সমালোচক ও পাঠক ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসকেই তাঁর সেরা কাজ হিসেবে গণ্য করেন। তবে ‘দেবদাস’, ‘ পল্লীসমাজ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘পথের দাবী’, ‘গৃহদাহ’ এবং ‘শেষ প্রশ্ন’-এর মতো উপন্যাসগুলিও তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস কয়টি?

শরৎচন্দ্রের কালজয়ী অতৃপ্ত ত্রিভুজ প্রেমের উপন্যাস ‘গৃহদাহ’ । এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সমসাময়িক বাঙালির পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থা, ব্যক্তিমানসের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম-পরিণয় ও বিশ্বাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তবে এই উপন্যাসের মূল উপজীব্যই প্রেম। আর প্রেমের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রহস্যময়ী এক নারী অচলা। তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে দুই পুরুষ, সুরেশ এবং মহিম।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস হলো ‘শ্রীকান্ত’। উপন্যাসটি প্রথম পর্ব (১৯১৭), দ্বিতীয় পর্ব (১৯১৮), তৃতীয় পর্ব (১৯২৭), এবং চতুর্থ পর্ব (১৯৩৩) — এই চারটি খণ্ডে সমাপ্ত। উপন্যাসে শ্রীকান্ত ছাড়াও অন্নদাদিদি, ইন্দ্রনাথ, রাজলক্ষ্মী, অভয়া, রোহিণী, গুরুদেব, কুশারী, গহর, কমললতা সহ আরও অনেক চরিত্র রয়েছে। এই উপন্যাসটি মূলত শ্রীকান্তের জীবনযাত্রা ও তার ভবঘুরে জীবনের কথা বলে। এই উপন্যাসটিকে শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন এবং আত্মজীবনীমূলক লেখা হিসেবে গণ্য করা হয়।

দেবদাস/ Devdas Sarat Chandra Chattopadhyay :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা জনপ্রিয় উপন্যাস হল ‘দেবদাস’। এটি মূলত একটি প্রণয়ধর্মী উপন্যাস। ১৯০০ সালে লেখা হলেও দীর্ঘদিন দ্বিধায় থাকার পর ১৯১৭ সালে এটি প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি দেবদাস, পার্বতী (পারু) এবং চন্দ্রমুখী নামের তিনজন প্রধান চরিত্রের একটি করুন ট্র্যাজেডিকে ঘিরে আবর্তিত হয়।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের একটি বিখ্যাত লাইন হলো : “দেবদাস ভাবিয়াছিলো তাহাকে ছাড়া পার্বতী মরিয়া যাইবে, অথচ তাহার জ্বরটুকু অবধি আসিল না।”। এই লাইনটি পার্বতীর ভালোবাসার প্রতি দেবদাসের ভুল ধারণাকে তুলে ধরে এবং তার আত্মসম্মানের গুরুত্ব বোঝায়। এই কথাটি উপন্যাসের শেষের দিকে দেখা যায়, যেখানে দেবদাস আশা করেছিল যে তার অনুপস্থিতিতে পার্বতী কষ্ট পাবে এবং মারা যাবে। কিন্তু বাস্তবে, পার্বতী দেবদাসের এমন ধারণার বিপরীতে নিজের আত্মসম্মানকে বড় করে রেখেছিল এবং নিজের জীবনে এগিয়ে গিয়েছিল। এই লাইনটি দেবদাসের ভালোবাসার প্রতি পার্বতীর ভালোবাসার গভীরতা ও আত্মমর্যাদার সংমিশ্রণকে প্রকাশ করে।

দেবদাস

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসের চরিত্র, Characters in the novel by Sarat Chandra Chatterjee :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে শ্রীকান্ত, রাজলক্ষ্মী, অভয়া, কমললতা, সাবিত্রী, কিরণময়ী, দেবদাস, পার্বতী, চন্দ্রমুখী, বৌরানি, বিপ্রদাস, রমা, বিনোদিনী ও সতীশ প্রমুখ চরিত্র। তাঁর নারী চরিত্রগুলি তাদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার জন্য পরিচিত, যা তৎকালীন সমাজে তাদের অবস্থানকে তুলে ধরে।

কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র:

  • শ্রীকান্ত: তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে পরিচিত হন।
  • রাজলক্ষ্মী: শ্রীকান্ত উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র, যিনি সাধারণ হয়েও অসাধারণ হয়ে উঠেছেন।
  • অভয়া: শ্রীকান্ত উপন্যাসের আরেকজন নারী চরিত্র, যিনি আত্মমর্যাদা ও মুক্তির প্রতীক।
  • কমললতা: শ্রীকান্ত উপন্যাসের এই চরিত্রটি তৎকালীন সমাজে নারীর আত্মমর্যাদা ও মুক্তিকে তুলে ধরে।
  • সাবিত্রী: চরিত্রহীন উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র এবং সতীশ নামক চরিত্রটি এই উপন্যাসের নায়ক।
  • কিরণময়ী: চরিত্রহীন উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র।
  • দেবদাস ও পার্বতী: এই জনপ্রিয় উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র।
  • বৌরানি: পরিণীতা উপন্যাসের শুচিসুদ্ধ পবিত্রতার প্রতীক।
  • বিপ্রদাস: বিপ্রদাস উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যিনি একজন সফল ও সুশিক্ষিত জমিদার।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম কয়টি ? How many pseudonyms did Sarat Chandra Chatterjee have?

আনিলা দেবী ছিল প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। এছাড়াও তাঁর বেশ কিছু ছদ্মনাম আছে, সেগুলি হল : অমুরুপা দেবী, অপরাজিতা দেবী, শ্রী চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, শ্রী কান্ডশর্মা, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র / শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছোট গল্প সমগ্র pdf, Sarat Chandra Chatterjee’s stories :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘মন্দির’ (১৯০৩), এবং ‘মহেশ’, ‘বিলাসী’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু ছোটগল্প।

উল্লেখযোগ্য কিছু ছোটগল্প :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম কয়টি ?
  • রামের সুমতি: (১৯১৪)
  • বিন্দুর ছেলে: (১৯১৪)
  • মেজদিদি: (১৯১৫)
  • আঁধারে আলো: (১৯১৫)
  • দর্পচূর্ণ: (১৯১৫)
  • নিষ্কৃতি: (১৯১৭)
  • কাশীনাথ: (১৯১৭)
  • বিলাসী
  • মহেশ
  • অভাগীর স্বর্গ
  • মামলার ফল
  • সতী
  • হরিলক্ষ্মী

শরৎচন্দ্রের চোখে নারীজাতি, Women in the eyes of Sarat Chandra :

শরৎচন্দ্রের চোখে নারী ছিল ক্ষমতাধর ও চিরন্তন গুণের অধিকারী, যিনি শুধুমাত্র স্নেহশীল ও সহনশীল নন, বরং প্রয়োজনে মহিষাসুর বধের ন্যায় শক্তিশালীও হতে পারেন। তিনি নারীকে সমাজের অবলা বা সেবিকা হিসেবে দেখার পরিবর্তে তার অন্তরের গভীরতা, আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম নারীর প্রতি সমাজের দমনমূলক মনোভাবের সমালোচনা করে এবং তাদের মুক্তি ও সম্মানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

শরৎচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে নারী শুধু নরম-সরম নয়। তিনি দেখিয়েছেন যে নারীরা তাদের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা এবং ইচ্ছাশক্তি নিয়ে সমাজের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম।

তাঁর উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো তৎকালীন পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে লড়াই করে। রাজলক্ষ্মী, অন্নদা, অভয়া এবং কমললতার মতো চরিত্ররা তাদের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা ও মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহসিকতা দেখায়। ছকভাঙা নারীদের কথাও তিনি লিখেছেন। বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, পতিতা, অরক্ষণীয়া প্রত্যেকেই সসম্মানে ঠাঁই পেয়েছেন শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন উপন্যাসে।

শরৎচন্দ্র স্পষ্ট করে বলেছেন যে সমাজ নারীকে কেবল তার সেবাপরায়ণতা, স্নেহশীলতা, সতীত্ব ও সহনশীলতার ভিত্তিতে বিচার করে, যা নারীর প্রকৃত মূল্যকে চাপা দেয়।

তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের উপর নির্ভর করে নারীকে অবমাননার দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রথাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন।

মাতৃত্বকেই নারীর চরম সার্থকতা বলে চাটুবাক্যে আচ্ছন্ন করে রাখা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। শরৎচন্দ্রের লেখায় নারীরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার সুযোগ এবং আত্মসম্মান অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।

তাঁর সৃষ্টিকর্ম শুধু কাল্পনিক নয়, বরং বাস্তব জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে নারীদের সংগ্রাম ও তাদের অন্তর্নিহিত গুণের প্রতিফলন।

শরৎ সাহিত্য / শরৎ সাহিত্য ও চলচ্চিত্রায়ন, Literature and Filmography of Sarat Chandra :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যচর্চার সূচনা ঘটে রেঙ্গুনে, যেখানে তিনি কুন্তলীন পত্রিকার জন্য ‘মন্দির’ গল্পটি লিখে পুরস্কৃত হন এবং এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। তাঁর সাহিত্যে গভীর মানবতাবোধ, সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তিনি সমসাময়িক সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে নারী, দারিদ্র্য ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখার মাধ্যমে। তাঁর সাহিত্যিক অবদানের জন্য তিনি কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি লাভ করেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাবলীর উপর ভিত্তি করে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “দেবদাস” বাংলা, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায় আটবার রূপান্তরিত হয়েছে।

দেবদাসের বিভিন্ন সংস্করণে প্রমোথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, উত্তম কুমার, সৌমিত্র চ্যাটার্জী, দিলীপ কুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, সুমিত্রা মুখার্জী, শাহরুখ খান, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন এবং মাধুরী দীক্ষিতের মতো খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেছেন।

তাঁর উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে অন্যান্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • “বড় দিদি” (সন্ধ্যারানী এবং উত্তম কুমারের সাথে)
  • “পরিণীতা” (সৌমিত্র চ্যাটার্জি এবং মৌসুমী চ্যাটার্জির সাথে) – দু’বার চিত্রায়িত
  • “চন্দ্রনাথ” (উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের সাথে)
  • “রাজলক্ষ্মী-ও-শ্রীকান্ত”
  • “বিরাজ বউ” (উত্তম কুমার এবং মাধবী মুখার্জীর সাথে)
  • “মাঝলি দিদি” (হিন্দিতে হৃষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত)
বিরাজ বৌ

“স্বামী” (1977) চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ গল্প লেখকের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছে। তাঁর ছোট গল্প ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্প অবলম্বনে “ছোটি বহু” (1971) নামে একটি হিন্দি ছবি তৈরি হয়।

১৯৭৬ সালে ‘দত্তা’ ছবিতে সুচিত্রা সেন ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে, 2013 সালে, তাঁর ‘নববিধান’ উপন্যাসের ভিত্তিতে ২০১৩ সালে ‘তুমহারি পাখি’ নামে একটি জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিকও তৈরি হয়।

শরৎচন্দ্রের কিছু অসামাপ্ত এবং টুকরো লেখা, Some unfinished and fragmentary writings of Sarat Chandra :

শেষের পরিচয়: এটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস। উপন্যাসটি ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রে ১৩৩৯ ও ১৩৪০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এর শেষ অংশ আর প্রকাশিত হয়নি।

তবে, তাঁর প্রকাশিত টুকরো লেখার বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু, পিতার অনেক লেখা অসম্পূর্ণ ছিল এবং সেগুলি পড়ে শরৎচন্দ্র সেগুলোর সমাপ্তি নিয়ে কল্পনার জাল বুনতেন এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাপ্তি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিন্তা করতেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁর লেখালেখিতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল?

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যেমন আর্থিক টানাপোড়েন তাঁর লেখায় গভীর সংবেদনশীলতা ও সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে, যা তাঁর উপন্যাসগুলিকে জীবনের প্রতিচ্ছবি করে তুলেছে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “পথের দাবী”-এর তাৎপর্য হলো এটি তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত, যেখানে একজন বিপ্লবীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবাদের এক শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস” পথের দাবি” এর তাৎপর্য কী ছিল? What was the significance of Sarat Chandra Chatterjee’s novel”Pather Daabi”?

“পথের দাবি” উপন্যাসের মূল তাৎপর্য ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিপ্লবীদের সংগ্রাম এবং তাদের দেশপ্রেমকে তুলে ধরা। উপন্যাসটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের (যেটি “পথের দাবি” নামে পরিচিত) উত্থান ও সংগ্রামের চিত্রায়ণ করে, যা ব্রিটিশদের শোষণের বিরুদ্ধে তরুণ ভারতীয়দের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা তৈরি করতে সহায়ক হয়েছিল এবং ব্রিটিশ ভারতে এটি নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। উপন্যাসটি সেই সময়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরে, যেখানে পরাধীনতার বিরুদ্ধে অনেক অজানা মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে একটি স্বাধীন জাতির স্বপ্ন দেখতেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু, Death of Sarat Chandra Chatterjee :

১৯৩৭ খ্রিঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে দেওঘরে চিকিৎসার জন্য যান। তাঁর যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, পরে কলকাতায় অস্ত্রোপচার করা হলেও সেটা ব্যর্থ হয়। তিনি ১৯৩৮ খ্রিঃ ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টায় কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

শেষ কথা :

বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান অসামান্য। তাই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি তাঁর শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

RIma Sinha

Rima Sinha is a professional journalist and writer with a strong academic background in media and communication. She holds a Bachelor of Arts from Tripura University and a Master’s degree in Journalism and Mass Communication from Chandigarh University. With experience in reporting, feature writing, and digital content creation, Rima focuses on delivering accurate and engaging news stories to Bengali readers. Her commitment to ethical journalism and storytelling makes her a trusted voice in the field.

Recent Posts