শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে (১৪৮৬-১৫৩৪) মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্ত, সমাজ সংস্কারক এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্মরণ করা হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা তাঁকে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে গণ্য করেন, যিনি ভক্তির মাধ্যমে ঐশ্বরিক প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একজন ভক্তের রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর জীবন, শিক্ষা এবং রহস্যময় অন্তর্ধান বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কে ছিলেন? Who was Sri Chaitanya Mahaprabhu?
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আসল নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। তিনি ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোল পূর্ণিমার (হোলি) দিনে বাংলার নবদ্বীপে চন্দ্রগ্রহণের সময় জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি একটি নিম গাছের নীচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁর মা তাঁকে স্নেহের সাথে নিমাই বলে ডাকতেন। তাঁর গৌর বর্ণের কারণে তিনি গৌরাঙ্গ নামটি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে, ত্যাগের পর, তিনি শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নামে পরিচিত হন।
তিনি ছিলেন পণ্ডিত বংশের ধার্মিক ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্র এবং শচী দেবীর পুত্র। অল্প বয়স থেকেই নিমাই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করেছিলেন, নবদ্বীপে ন্যায় (যুক্তি) এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের একজন মেধাবী পণ্ডিত হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তবে, গয়াতে তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাথে তাঁর সাক্ষাতের ফলে এক গভীর আধ্যাত্মিক রূপান্তর ঘটে, যা তাঁকে একজন বিখ্যাত পণ্ডিত থেকে কৃষ্ণের একজন অনুরাগী ভক্তে পরিণত করে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম তারিখ / শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান কোথায়? / শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান মায়াপুর নয়! কী জানাচ্ছে ইতিহাস? কোথায় জন্মেছিলেন? Birth of Sri Chaitanya Mahaprabhu

শ্রীচৈতন্যের জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৬ সালে, ফাল্গুন পূর্ণিমা তিথিতে, এক চন্দ্রগ্রহণের সময়। বিশ্বজুড়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা তাঁর জন্মকে গৌর পূর্ণিমা হিসেবে পালন করেন।
ঐতিহ্যগতভাবে, শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপ বলে মনে করা হয়, বিশেষ করে যোগপীঠ নামে একটি স্থান, যা পরবর্তীতে মায়াপুরের সাথে চিহ্নিত হয়। কিছু ঐতিহাসিক যুক্তি দেন যে নবদ্বীপ এবং মায়াপুর তাঁর সময়ে স্বতন্ত্র স্থান ছিল, কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যের মধ্যে, মায়াপুর সর্বজনীনভাবে তাঁর জন্মস্থান হিসেবে গৃহীত।
শ্রীচৈতন্যের আসল নাম কী? What is Sri Chaitanya’s real name?
জন্মের সময় তাঁর দেওয়া নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। পরে, তাঁকে স্নেহে নিমাই বলা হত। ২৪ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণের পর, তাঁর গুরু কেশব ভারতী তাঁকে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম দিয়েছিলেন।
নিমাইয়ের পিতার নাম কী ছিল? What was the name of Nimai’s father?
শ্রীচৈতন্যের পিতা ছিলেন জগন্নাথ মিশ্র, যিনি মূলত ওড়িশার একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন শচী দেবী, ভক্তরা তাঁকে শচী মাতা নামে শ্রদ্ধা করতেন।
শ্রীচৈতন্যদেব কোন শাসকের আমলে ভক্তি ধর্ম প্রচার করেন? During the reign of which ruler did Sri Chaitanya spread the religion of Bhakti?
শ্রীচৈতন্য পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাস করতেন, যা ভারতে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক উত্থানের সময় ছিল। বাংলায়, বাংলার সুলতানি ছিল মুসলিম শাসনের অধীনে, যখন উড়িষ্যায়, গজপতি রাজবংশের বিকাশ ঘটে। পুরীতে তাঁর পরবর্তী বছরগুলিতে, রাজা প্রতাপরুদ্র দেব (১৪৯৭-১৫৪০) ছিলেন রাজত্বকারী।
একজন ধর্মপ্রাণ শাসক রাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যের একজন ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং তাঁর সংকীর্তন (ভক্তিমূলক সমবেত জপ) আন্দোলনকে সমর্থন করেন। সেই যুগের রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও, চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন জাতি, ধর্ম এবং সামাজিক শৃঙ্খলার বাধা অতিক্রম করে হিন্দু ও মুসলমান উভয়কেই ভক্তিমূলক গান এবং আধ্যাত্মিক পরমানন্দের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধানের রহস্য / শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মৃত্যু রহস্য / চৈতন্য মহাপ্রভুর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল? The mystery of Sri Chaitanya’s disappearance
শ্রীচৈতন্যের পার্থিব জীবনের সমাপ্তি রহস্যে ঢাকা। তিনি তাঁর শেষ বছরগুলি জগন্নাথ পুরীতে কাটিয়েছিলেন, ক্রমাগত পরমানন্দপূর্ণ ভক্তি এবং কীর্তনে মগ্ন ছিলেন। ১৫৩৪ সালের ১৪ জুন, তিনি রহস্যময় পরিস্থিতিতে অন্তর্ধান করেন।
তার অন্তর্ধান সম্পর্কে একাধিক তত্ত্ব রয়েছে:

- দেবতার সাথে মিলিত হওয়া – কিছু ঐতিহ্য বিশ্বাস করে যে তিনি জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন এবং ভগবান জগন্নাথের মূর্তিতে মিলিত হয়েছিলেন।
- সমুদ্রের সাথে মিলিত হওয়া – অন্য একটি বিবরণে বলা হয়েছে যে তিনি সমাধিস্থ অবস্থায় সমুদ্রে প্রবেশ করেছিলেন এবং আর ফিরে আসেননি।
- সরল মৃত্যু – কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে তিনি স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন এবং তাঁর ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য তাঁর অনুসারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর মৃত্যু গোপন রেখেছিলেন।
এই অন্তর্ধান রহস্য তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকগুলির মধ্যে একটি।
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত / চৈতন্য চরিতামৃত কী? Sri Chaitanya Charitamrita :
ষোড়শ শতাব্দীতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী রচিত চৈতন্য চরিতামৃত হল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সবচেয়ে প্রামাণিক জীবনী। অসংখ্য সংস্কৃত উদ্ধৃতি সহ বাংলায় লেখা, এটি তাঁর জীবন, শিক্ষা, দর্শন এবং অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করে।
এই রচনাটি তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- আদি লীলা – প্রাথমিক জীবন এবং পটভূমি।
- মধ্য লীলা – তাঁর প্রচার, কীর্তন এবং দার্শনিক বক্তৃতা।
- অন্ত্য লীলা – পুরীতে তাঁর শেষ বছর এবং রহস্যময় অন্তর্ধান।
এই গ্রন্থটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রবিন্দু এবং একটি আধ্যাত্মিক ধর্মগ্রন্থ হিসেবে সম্মানিত।
চৈতন্যচরিতামৃত – কৃষ্ণদাস কবিরাজ এর গ্রন্থ / চৈতন্য জীবনী গ্রন্থের নাম কী? What is the name of the book on Chaitanya’s biography?
চৈতন্য মহাপ্রভুর মূল জীবনীগুলি হল:
- বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্য ভাগবত
- লোচন দাস ঠাকুরের চৈতন্য মঙ্গল
- কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্য চরিতামৃত
এই রচনাগুলি চৈতন্য সাহিত্যের ভিত্তি তৈরি করে এবং শতাব্দী ধরে অগণিত ভক্তদের অনুপ্রাণিত করে আসছে।
চৈতন্য আবির্ভাবের কারণ কী ছিল?
গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে, চৈতন্যের অবতারের উদ্দেশ্য ছিল দুটি:
- কৃষ্ণের প্রতি রাধার ঐশ্বরিক প্রেম উপভোগ করা, ভক্তির সর্বোচ্চ রূপ প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা।
- কলিযুগে মুক্তির সবচেয়ে সহজ পথ হিসেবে পবিত্র নাম (হরিনাম সংকীর্তন) জপ ছড়িয়ে দেওয়া।
তাঁর লক্ষ্য ছিল ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি এবং প্রেমের মাধ্যমে বর্ণ ও ধর্মের মানুষকে একত্রিত করা।
শ্রীচৈতন্যকে গৌরচাঁদ কেন বলা হয়?
চৈতন্য মহাপ্রভুকে প্রায়শই গৌরাঙ্গ বা গৌরচাঁদ বলা হত কারণ তাঁর উজ্জ্বল সোনালী বর্ণের জন্য। “গৌর” শব্দের অর্থ “সুন্দরী” বা “সোনালী” এবং “চাঁদ” অর্থ “চাঁদ”। সুতরাং, গৌরচাঁদ সোনালী চাঁদের প্রতীক, যা বিশ্বজুড়ে আলো এবং প্রেম ছড়িয়ে দেয়।
“চৈতন্য” শব্দের অর্থ কী?
সংস্কৃতে “চৈতন্য” শব্দের অর্থ “চেতনা” বা “আধ্যাত্মিক সচেতনতা”। এটি ঐশ্বরিক চেতনার জাগ্রত অবস্থাকে বোঝায়, যা চৈতন্য তাঁর অনুসারীদের মধ্যে মূর্ত করেছিলেন এবং ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
চৈতন্য মহাপ্রভুর স্ত্রী কে ছিলেন?
শ্রীচৈতন্য দুবার বিবাহিত ছিলেন :
- লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী – তাঁর প্রথম স্ত্রী, যিনি অল্প বয়সে মারা যান।
- বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী – তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, যিনি চৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের পর কঠোর ভক্তিপূর্ণ জীবনযাপন করেছিলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীকে ত্যাগ ও ভক্তির প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয়।
চৈতন্যমঙ্গল এর রচয়িতা কে?

চৈতন্য মঙ্গল রচনা করেছিলেন লোচন দাস ঠাকুর, যিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ও অলৌকিক ঘটনাগুলিকে ভক্তিমূলক ও কাব্যিকভাবে চিত্রিত করেছিলেন। এই রচনাটি সাধারণ মানুষের কাছে এর সহজলভ্য ভাষা এবং ভক্তিমূলক উৎসাহের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
গৌর-নিতাই কে? Who are Gaur-Nitai?
গৌর-নিতাই বলতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (গৌর) এবং নিত্যানন্দ প্রভু (নিতাই) কে বোঝায়। একসাথে, তারা হরিনাম সংকীর্তনের অনুশীলন বাংলা ও উড়িষ্যা জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে সকলকে আধ্যাত্মিক মুক্তি এবং আনন্দ প্রদান করে। ভক্তরা প্রায়শই ঐশ্বরিক ভ্রাতৃত্ব এবং করুণার প্রতীক হিসেবে “গৌর-নিতাই” জপ করেন।
গৌরাঙ্গ শব্দের অর্থ কী? What does the word Gauranga mean?
গৌরাঙ্গ শব্দের আক্ষরিক অর্থ “সোনার দেহধারী”। এটি চৈতন্যের উজ্জ্বল, উজ্জ্বল সোনালী বর্ণকে বোঝায়।
নিতাই শব্দের অর্থ কী? What does the word Nitai mean?
নিতাই হল চৈতন্যের নিকটতম সঙ্গী নিত্যানন্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এই শব্দের অর্থ “চিরন্তন আনন্দ” বা “যিনি চিরন্তন আনন্দ দান করেন।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উত্তরাধিকার, The Legacy of Sri Caitanya Mahaprabhu :
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুলিতে জোর দেওয়া হয়েছিল:
- পবিত্র আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে পবিত্র নাম (“হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র”) জপ করা।
- জাতি ও ধর্মের ঊর্ধ্বে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব।
- ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের শক্তিকে তুলে ধরে আচার-অনুষ্ঠানের উপর ভক্তি।
- শুষ্ক বুদ্ধিবৃত্তিকতাকে অতিক্রম করে সর্বোচ্চ পথ হিসেবে ভক্তি।
তাঁর অনুসারীরা, বিশেষ করে বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামী, গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনকে সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আজ, আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সমিতি (ইসকন) এর মতো আন্দোলন বিশ্বব্যাপী তাঁর বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
উপসংহার
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কেবল একজন সাধুই ছিলেন না, একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন যিনি ভারতে আধ্যাত্মিক সাধনায় বিপ্লব এনেছিলেন। তাঁর জীবন, শিক্ষা এবং রহস্যময় অন্তর্ধান ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে একটি স্থায়ী অধ্যায় গঠন করে। নিমাই, গৌরাঙ্গ, অথবা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামেই স্মরণ করা হোক না কেন, তিনি হলেন সেই উজ্জ্বল সোনালী চাঁদ যিনি বিশ্বজুড়ে ঐশ্বরিক প্রেম এবং পবিত্র নামগুলির জপ ছড়িয়ে দিয়েছেন।